ঈশ্বরদী ললিতকলা একাডেমি। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সংগীত প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। পৌর শহরের মূল ফটক রেলওয়ে ওভারব্রিজের উত্তর পাশেই অবস্থিত এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানটি নানা অব্যবস্থাপনায় এখন অস্তিত্ব সংকটে। যেখানে সকাল-বিকাল সংগীত, নাচ প্রশিক্ষণসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রায় অধিকাংশ অনুশীলন করা হতো সেখানে এখন বসবাস জীবজন্তুর।
দীর্ঘ সময় ধরে দরজা তালাবদ্ধ, একাডেমি ভবনেরও বেহাল দশা। স্থানীয়দের ফেলা ময়লার স্তূপে যেন ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে একাডেমির চারপাশ। একাডেমি দেখে বোঝার উপায় নেই এটি কোনো জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী ললিতকলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটির জৌলুস ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ চেয়েছে স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ।
জানা গেছে, ১৯৭২ সালে প্রয়াত সাংবাদিক মহসিন রিয়াজী রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ১০০ বছরের লিজ নিয়ে ১ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন ঈশ্বরদী ললিতকলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ১২০ জন প্রশিক্ষক এসে এ একাডেমিতে চারশ ছাত্রছাত্রীর সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিতেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ললিতকলা একাডেমির প্রবেশ পথে বৃষ্টির পানি জমে যাতায়াতের অনুপযোগী। বন্ধ দরজার মরিচাধরা তালা আর ভাঙাচোরা জানালাগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে অব্যবস্থাপনার নানা দৃশ্য। একডেমি ভবনের চরপাশের প্রাচীর আগাছায় ছেয়ে গেছে। আশপাশের ফেলা ময়লার স্তূপে বোঝার উপায় নেই এটি কোনো ঐতিহ্যবাহী ললিতকলা একাডেমি। ভবনের দেয়াল ও শানসেটের পলেস্তারা খসে মরিচাযুক্ত রড বের হয়ে আছে। ওপরের টিনের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে একাকার ভিতর অংশ। নৃত্য পরিবেশনের মঞ্চের কাঠ ও বাটাম পচে তা ব্যবহারের অনুপযোগী। ঝুল আর ময়লা জমে পচা দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়েছে একাডেমির রুমগুলোতে।
ললিতকলা একাডেমি থেকে গিটার ও গান শিখেছেন কলেজ পাড়া এলাকার সোহান নূর সোহান। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, একসময়কার প্রাণচাঞ্চল্যকর ললিতকলা একাডেমি এখন নির্জীব এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। যে প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময় সংগীত প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন করেছি সে প্রতিষ্ঠান নানা অবহেলায় আজ হারানোর পথে। ঈশ্বরদী ললিতকলা একাডেমি ঈশ্বরদীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠান যদি এভাবে বন্ধ হয়ে যায় তবে একদিকে ঈশ্বরদী যেমন সাংস্কৃতি থেকে পিছিয়ে পড়বে অন্যদিকে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও সাংস্কৃতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।
একাডেমির সংগীত প্রশিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, আমি ১৯৮০ সাল থেকে এই একাডেমিতে গান শিখাচ্ছি। একটা সময় ছিল যখন এ প্রতিষ্ঠানে সকাল-বিকাল সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও চর্চা হয়েছে। এখান থেকে গান, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য শিখে অনেকেই আজ দেশের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডে কাজ করছেন। কিন্তু আগের ললিতকলা একাডেমি আর এখনকার একাডেমির কোনো মিল নেই। আমরা চাই এ একাডেমি আবার আগের মতো জৌলুসতা ফিরে পাক।
একাডেমির গিটার প্রশিক্ষক তৌহিদুল ইসলাম তরুণ বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এ ললিতকলা একাডেমিতে যাতায়াত করছি। আমি এ একাডেমি থেকে গিটার শিখেছি আবার এ একাডেমিতেই ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের গিটার বাজানো শিখিয়েছি। একাডেমির ভগ্নদশা দেখে মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়। ঈশ্বরদী ললিতকলা একাডেমি এতটাই ঐতিহ্যবাহী ছিল যে অ্যান্ড্রু কিশোর, সুবীর নন্দী, খুরশিদ আলম, ফরিদা পারভিনের (লালন) মতো জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীরা এসেও এখানে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
ঈশ্বরদী ললিতকলা একাডেমি কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম লিটন বলেন, অনেকদিন যাবৎ একাডেমিতে আর আগের মতো সংগীত প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন করা হয় না। আমরা ইতোমধ্যে কমিটির লোকজন বসে একাডেমি পুনরায় চালু করার ব্যাপারে কথা বলেছি।
পাকশি বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার শাহ সুফী নূর মোহাম্মদ বলেন, ললিতকলা একাডেমি সম্পর্কে আমার জানা নেই। তবে একাডেমি কমিটির লোকজন যদি তাদের দাবি নিয়ে সেটি পুনরায় চালুর আবেদন জানিয়ে দরখাস্ত দেন তাহলে খোঁজখবর নিয়ে চালুর ব্যাবস্থা করব।
পাকশি বিভাগীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান বলেন, প্রতিষ্ঠানটি রেলের আওতাধীন কি না এটা সঠিক আমার জানা নেই। সংস্কারের জন্যও কেউ এ পর্যন্ত কোনো যোগাযোগও করেনি। খোঁজখবর নিয়ে যদি দেখি রেলের আওতাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান তবে সেটা চালুর ব্যবস্থা করা হবে।