ঈশ্বরদী ইপিজেডে জাপানি মালিকানাধীন নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কম্পানিতে তিন বাঙালি কর্মকর্তার ষড়যন্ত্রের কারণে চাকরি হারানোর আতঙ্কে রয়েছেন কারখানার দুই হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। ইতিমধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তদন্ত কমিটির দুই সদস্যসহ ১৮ জন শ্রমিক ও কর্মকর্তাকে। পর্যায়ক্রমে চাকরিচ্যুত করতে করা হয়েছে তালিকা। এ নিয়ে কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছে।
চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
তিন কর্মকর্তারা হলেন প্রশাসনিক ব্যবস্থাপক (অ্যাডমিন ম্যানেজার) মো. মেহেদী হাসান, উৎপাদন ব্যবস্থাপন (পিএম) মো. আব্দুল মতিন ও সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপক (এপিএম) মো. ফরহাদ বাবু। এই তিন কর্মকর্তার ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা ধরার কারণেই শ্রমিকদের উসকে দেওয়া আন্দোলনে চাকরিচ্যুত হয়েছেন শ্রমিক থেকে নির্বাহী কর্মকর্তা ও জাপানি দোভাষী সুইটি আক্তারসহ জাপানি নাগরিক কম্পানির প্রধান নির্বাহী পরিচালক কাজী হারাসান।
নাকানো কম্পানিকে টিকিয়ে রাখতে এই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে কম্পানির শ্রমিক-কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ঈশ্বরদী ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) বরাবর অভিযোগ করা হয়েছে।
একই সঙ্গে নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কম্পানি লিমিটেডের পক্ষ থেকেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শ্রমিক-কর্মচারীদের মিথ্যা প্রলোভনে উসকে দিয়ে কম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ণসহ অর্থনৈতিক লোকসান করার সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
বেপজায় লিখিত অভিযোগ, শ্রমিক-কর্মচারী ও নাকানোর তদন্ত কমিটির সদস্যদের সূত্রে জানা যায়, কম্পানির তিন বাঙালি কর্মকর্তা পরস্পর যোগসাজশে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারী মুখ খুললে তারা বিভিন্ন প্রলোভনে অন্যান্য শ্রমিক-কর্মচারীদের উসকে দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করান।
ফলে এসব কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কোনো কারণে আন্দোলনকারী শ্রমিক-কর্মচারীরা তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে তারা জাপানি মালিককে অসত্য তথ্য দিয়ে তাদেরও চাকরিচ্যুত করান। এমন ঘটনাই গত ২৭ মার্চ সকালে ঘটেছে।
সূত্রগুলো মতে, কম্পানিটি জাপানি ভাষা জানা সুইটি আক্তারকে শ্রমিক থেকে নির্বাহী কর্মকর্তাসহ দোভাষীর দায়িত্ব দেয়। ওই তিন কর্মকর্তার যোগসাজশে বার্ষিক কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেন।
এ কারণে কম্পানিটির জাপানি মালিকসহ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী হারাসান এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ধরার দায়িত্ব দেন নির্বাহী কর্মকর্তা সুইটি আক্তারকে। তিনি খোঁজখবর নিয়ে তাদের দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরে ফেলেন। এর পরই তারা পরিকল্পিতভাবে সুইটি আক্তারসহ কাজী হারাসনকে চাকরিচ্যুত করতে আন্দোলন করান। এতে কম্পানিতে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
কম্পানির একাধিক শ্রমিক জানান, আমরা অ্যাডমিন ম্যানেজার মেহেদী হাসান, পিএম আব্দুল মতিন, এপিএম ফরহাদ বাবু স্যারসহ কয়েকজন স্যারের কথামতো আন্দোলন করেছি। আমাদের মধ্যে থেকে যারা তদন্ত কমিটির নিকট সত্যতা স্বীকার করেছেন তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমরা এখন চাকরিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছি। এসব নিয়ে কম্পানিতে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে।
তারা আরো জানান, কম্পানির প্রধান নির্বাহী পরিচালক জাপানি নাগরিক কাজী হারাসন জাপানে ফিরে গেছেন। এই সুযোগে জাপানি ভাষা জানা অ্যাডমিন ম্যানেজার মেহেদী হাসান, পিএম আব্দুল মতিন জাপানে থাকা কম্পানির মালিককে শ্রমিক কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরিচ্যুত করছেন।
নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কম্পানি লি. স্টোরকিপার সজল আহমেদ জানান, তিন কর্মকর্তা কারখানার বিভিন্ন মালামাল ক্রয় কেনাকাটা ও সাবকন্ট্রাক্টের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি মেরামতে অনিয়ম-দুর্নীতি করেন। এসব দুর্নীতি ধরে ফেলায় আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
সুইং অপারেটর সোহানা ইয়াসমিন, শাপলা খাতুন, রানী, মহির উদ্দিন, রমজান আলী, ফিরোজ আহমেদ জানান, কম্পানির অ্যাডমিন ম্যানেজার মেহেদী হাসান, পিএম আব্দুল মতিন ও এপিএম ফরহাদ বাবু নিজেরা দুর্নীতি করে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের স্বার্থে আমাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্দোলন করিয়েছেন। আমরা পরবর্তীতে বিষয়টি বুঝতে পেরে তদন্ত কমিটির নিকট সত্য প্রকাশ করায় আমাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
নাকানো নির্বাহী কর্মকর্তা ও দোভাষী সুইটি আক্তার জানান, সত্য বের করায় তিন কর্মকর্তা মিথ্যা তথ্য দিয়ে শ্রমিকদের উসকে দেন, বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আন্দোলন করান। তার প্রমাণ তদন্ত কমিটি পেয়েছে। বর্তমানে কম্পানিতে জাপানি কোনো পুরাতন কর্মকর্তা না থাকার সুযোগে তারা শ্রমিক-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করিয়ে সত্য ঢাকার চেষ্টা করছেন।
শ্রমিক-কর্মচারীদের করা আন্দোলনের বিষয়ে নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কম্পানির করা তদন্ত কমিটির রকিব আহমেদ ও মো. সুমন জানান, তদন্তে শ্রমিকদের মিথ্যা প্রলোভনে উসকে দিয়ে আন্দোলন করানোর সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি মালিকের হাতে দিতে হলে তাদের মাধ্যমেই দিতে হবে। তাই চাকরিচ্যুত হওয়ার ভয়ে প্রতিবেদনটি মালিকের নিকট জমা দিতে পারছি না।
নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কম্পানির অ্যাডমিন ম্যানেজরা ও দোভাষী মেহেদী হাসান জানান, চাকরিচ্যুত হওয়ার পর এখন আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে। আমরা শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করার ক্ষেত্রে কিছুই জানি না। শ্রমিকদের উসকে দিয়ে আন্দোলন করানোর তথ্যটি সত্য নয়।
কম্পানির প্রডাকশন ম্যানেজার (পিএম) মো. আব্দুল মতিন জানান, শ্রমিক আন্দোলন, চাকরিচ্যুত করা ও আর্থিক কোনো দুর্নীতির সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হচ্ছে।
ঈশ্বরদী ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক (ইডি) মো. আনিসুর রহমান জানান, নাকানো ইন্টারন্যাশনাল কম্পানিটিতে শ্রমিক আন্দোলন ও চাকরিচ্যুত করার ঘটনায় বেপজা থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। কম্পানিটি জাপানি মালিকানাধীন। তাই যেকোনো বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়াটা সময়ের ব্যাপার।
আরো পড়ুন : ঈশ্বরদী ইপিজেডে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকায় রপ্তানি আয় বাড়ছে