শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ের বিভাগীয় শহর ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের ‘রূপপুরে’ চলছে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল কর্মযজ্ঞ।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণ এখন চূড়ান্ত ধাপে।
রাশিয়ার থেকে সমুদ্রপথে আনা হয় ভারী যন্ত্রাংশ। পরিবহনে সড়ক এবং নৌপথের পাশাপাশি এবার যুক্ত হচ্ছে রেলপথ।
যা এখন উদ্বোধন হওয়ার প্রহর গুনছে।
আজ বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টায় ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ প্রতিক্ষার এই প্রকল্প উদ্বোধন করবেন।
বন্দর থেকে সরাসরি প্রকল্প এলাকায় মালামাল পরিবহনের জন্য ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন থেকে রূপপুর পারমাণবিক পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৫২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেললাইন, ১৩টি লেভেল ক্রসিং গেট, রূপপুর নামে অত্যাধুনিক নতুন স্টেশন, একটি প্লাটফর্ম বানানো হয়েছে।
প্রকল্পটি উদ্বোধনের পর বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এদিকে প্রকল্পটি উদ্বোধনকে ঘিরে সাজ সাজ বর রূপপুর রেলওয়ে স্টেশনে।
এ প্রকল্পের আওতায় সংস্কারের মুখও দেখেছে শতবর্ষী ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনটি। মান্ধাতা আমলে তৈরি নিচু প্লাটফর্মটি উঁচু, ম্যানুয়াল পদ্ধতি বাদ দিয়ে কম্পিউটারইজ সিগনালিং সিস্টেম। এতে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা কম। নির্মাণ করা হয়েছে ঈশ্বরদী লোকোমোটিভ কারখানায় ডকপিট, ডুয়েলগেজ ইঞ্জিনে কোনো ক্রুটি আছে কি-না? তা পরীক্ষা করা যাবে।
রূপপুরের মালামাল ছাড়াও মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে এই রেলপথে বড় অংকের রাজস্ব আয়ের আশাবাদ পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে ঈশ্বরদী রূপপুর স্টেশনে সৌন্দর্য বর্ধনের শেষ মুহূর্তের কাজ। চারিদিক ব্যানার দিয়ে সাঁজানো হয়েছে। রূপপুর রেল স্টেশনের পাশে বিশাল মঞ্চ, সব আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য প্যান্ডেলে বসবার ব্যবস্থাও করেছেন।
এদিকে নবনির্মিত নতুন রূপপুর রেল স্টেশনে ইঞ্জিনসহ মালবাহী ৫ ওয়াগনের একটি ট্রেন ঈশ্বরদী থেকে রূপপুর স্টেশনে নিয়ে আসা হয়েছে উদ্বোধনের জন্য। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পক্ষ থেকে সব আয়োজন সম্পন্ন। শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ট্রেনটি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে আকর্ষণীয় সাজে। রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, রেলওয়ে পুলিশ ও পাবনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোড়দার করা হয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পাবনার ঈশ্বরদী থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সালের পহেলা এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর্মযজ্ঞ চলে প্রকল্পে।
ভারতের জিপিটি ও বাংলাদেশের এসইএল ও সিসিএল অংশীদারত্বের ভিত্তিতে (জয়েন্ট ভেঞ্চার) ৩৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ঈশ্বরদী বাইপাস টেক অফ পয়েন্ট থেকে পাকশীর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৫২ কিলোমিটার ব্রডগেজ-মিটারগেজ (ডুয়েল গেজ) রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া, ১৩ টি লেবেল ক্রসিং গেট, একটি ‘বি’ শ্রেণির সুদৃশ্য স্টেশন ভবন, একটি প্লাটফর্ম, সাতটি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ঈশ্বরদী জংশন রেলওয়ে স্টেশনের দুইপাশ জুড়ে লুপলাইন সংস্কার করা হয়েছে, প্লাটফর্ম উঁচুকরণ কারণে ঈশ্বরদী স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেন থেকে যাত্রীরা হেঁটে ট্রেন থেকে সহজেই নামতে ও উঠতে পারে, একইসঙ্গে ১৮টি ট্রেন এসে দাঁড়াতে পারবে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী শিপন আলী জানান, এ প্রকল্পের আওতায় ঈশ্বরদী জংশনে পুরোনো মান্ধাতা আমলের রিলে- ইন্টারলকিং পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে কম্পিউটারইজড পদ্ধতি চালু হয়েছে। ঈশ্বরদী সুইচ কেবিন থেকে বাটন চাপলে ট্রেন আসা যাওয়ার রেললাইনটি ক্লিয়ার হবে সহজে, কোন ট্রেন আউটারে এসে লাইন ক্লিয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এ রেলরুটে মালপত্র আসা-যাওয়ার জন্য ট্রেনের যে লোকোমোটিভ যে ইঞ্জিন আসবে। তা পরীক্ষার জন্য ঈশ্বরদী লোকোমোটিভ কারখানায় ডকপিট নির্মিত হয়েছে। যার মাধ্যমে একই সময়ে একটি মিটারগেজ ট্রেনের ইঞ্জিন, নয়টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন পরীক্ষা করা যাবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে পাকশী বিভাগীয় সেতু প্রকৌশলী মো. আব্দুর রহিম জানান ঈশ্বরদীতে ইপিজেড আছে, তাদের কন্টেইনার ও অভ্যন্তরীণ সব মালমাল ভারত, নেপাল, ভূটানসহ উত্তরাঞ্চলে সব আমদানিকৃত মালমাল এখানে আনলোড করে স্বল্প খরচেই গন্তব্যে পৌঁছানো সহজ করার জন্য একটি আনলোডিং সেড নির্মাণ করা হয়েছে রূপপুর রেলস্টেশনে। এখানে জায়গা প্রচুর রয়েছে, তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে এখানে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের যান্ত্রিক প্রকৌশলী (ক্যারেজ) মমতাজুল ইসলাম সোহান জানান, ঈশ্বরদী-রূপপুর রেললাইন প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। একটি লোকোমোটিভ ইঞ্জিনসহ পাঁচটি মালবাহী কোচ সুদৃশ্যভাবে সাজানো হয়েছে।
পাকশী বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) আনোয়ার হোসেন জানান, পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের পরিবহন দফতর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাঁচটি মালবাহী ওয়াগনের একটি ট্রেন প্রস্তুত রেখেছেন। আগামীকালকে উদ্বোধনের পর রূপপুর থেকে ট্রেনটি ছাড়বে। তবে এলাকার জনগণের চাহিদা বিবেচনা করেই পরবর্তীতে দ্রুত সময়ের মধ্যে এ রুটে মালবাহী ট্রেন চলবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুল হক জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলওয়েকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যেতে চান। ঈশ্বরদী থেকে রূপপুর প্রকল্পে ট্রেন চলাচল শুরু, তারই একটা অংশ। আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী রেলওয়ের এই প্রকল্প সমাপ্তি করে বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচলের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করবেন।
বাণিজ্যে অপার সম্ভাবনায় দুয়ার খুলছে রূপপুর রেলস্টেশন রেলপথের মন্তব্য করে পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহা-ব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার জানান, এই অঞ্চল ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ হবে, মানুষের কর্মসংস্থান বাড়বে, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।