প্রতিবেশী লাইলি আক্তারের (৩০) সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ট্রাক্টরচালক আমির হোসেন (২৫)। বয়সে পাঁচ বছরের বড় লাইলির সঙ্গে আমিরের সম্পর্ক বছরখানেকের। হঠাৎ একদিন আমিরকে লাইলির সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে আমিরের পাঁচ বছরের শিশুকন্যা ফাহিমা।
ফাহিমা বলে, ‘আমি এ কথা মাকে জানিয়ে দেবো।’ এ কথাই কাল হয় ফাহিমার। ঘটনা চাপা দিতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী লাইলির প্ররোচনায় চকলেট কিনে দেওয়ার কথা বলে ফাহিমাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন বাবা আমির হোসেন।অন্য নারীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলায় শিশুটিকে খুন করতে হাত কাঁপেনি জন্মদাতা বাবার। ঘটনাটি কুমিল্লার দেবিদ্বারের। গত ৭ নভেম্বর নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
৯ নভেম্বর রাতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্যালিকার পাঁচ বছরের শিশু সন্তান সানিকে হত্যা করে শিশুটির খালু চাঁন মিয়া। পরে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনসহ মূল আসামি চাঁন মিয়াকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এ ঘটনার দুই সপ্তাহ না পেরোতেই ২৬ নভেম্বর একই ধরনের আরেকটি নৃশংস ঘটনা ঘটে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে। এবার নেশার টাকার জন্য ২২ দিন বয়সী ছেলে সন্তানকে বটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন সুভাস মহন্ত (২৮) নামে পাষণ্ড এক বাবা। পরে তাকে আটক করে পুলিশ।
শুধু ফাহিমা, সানি কিংবা ২২ দিনের শিশু নয়, গত ১০ মাসে শিশুর মা, বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছে অন্তত ৫০৯ জন শিশু।
এর মধ্যে অন্যতম, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে মাদরাসাছাত্রী মাইশা হত্যাকাণ্ড। ৩০ অক্টোবর পরকীয়ায় বাধা দেওয়ায় মাইশাকে খুন করে তার মা স্বপ্না আক্তার। ৩ জুন ঠাকুরগাঁওয়ে পরকীয়ার জেরে শিশুপুত্রকে খুন করেন তার মা জান্নাতা। একই কারণে রাজধানীতে ৩০ আগস্ট স্ত্রী ও শিশুপুত্র খুন করেন আবদুল ওয়াহিদ। ১ জুলাই স্বামীর হাতে খুন হন বরগুনার সুমাইয়া ও তার মেয়ে সামিরা আক্তার জুঁই।
পরকীয়া, মাদক, নৈতিক অবক্ষয়, সাইবার দুনিয়ার প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তি ও পারিবারিক বিশৃঙ্খল জীবনে শিশুরা বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা পরিবারের শিশুদের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
শিশুর জীবন এমন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিপন্ন হলে তার ভাই-বোনসহ কাছের শিশুদের জীবনযাত্রায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। শিশুদের নিয়ে কাজ করা একাধিক বেসরকারি সংগঠন বলছে, শিশুদের ওপর নৃশংসতার তথ্য সংগ্রহ এবং তা প্রতিরোধ নিয়ে গবেষণা অর্থাভাবে ঠিকমতো হচ্ছে না। ফলে সঠিক তথ্য পেতেও বেগ পেতে হচ্ছে। হয়তো সহিংসতার শিকার শিশুর সংখ্যা আরও বেশি।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম। প্রায় এক যুগ ধরে সংগঠনটি শিশুদের ওপর নৃশসংতার তথ্য ও ডাটা সংগ্রহ করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটিতে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, গত বছরের মাঝামাঝি থেকে তাদের প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে।
গবেষণায় দেখা যায়, বিপথে চলে যাওয়া শিশুদের মা-বাবাকে সমাজ ভালোভাবে নেয় না। বৈবাহিক জীবনের বাইরে অন্য নারী-পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না সমাজে। এমন বাস্তবতায় অনেকেই নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। যার প্রভাব পড়ে শিশুসন্তানের ওপর। আবার অন্যদের ফাঁসাতে মা-বাবার সন্তানকে খুন করার মতো নৃশংসতাও ঘটছে হরহামেশা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিম্নআয় ও শিক্ষার আলো পৌঁছেনি এমন মানুষের মধ্যে শিশুনির্যাতন এবং হত্যার ঘটনা বেশি। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটলে মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটবে। তখন পারিবারিক স্বস্তি আসবে। লোভের বলি হবে না শিশুরা।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৫০৯ শিশুকে খুন করা হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২০৫টি। ১৪৫ শিশুকে বাসা থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে ও অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে ১২৭ শিশুকে। খুন হওয়া শিশুদের মধ্যে ১১৫ জনের বয়স ৬ বছরের নিচে।
মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে শিশুর প্রতি নৃশংসতার মাত্রা বাড়ছে। শিশুদের প্রতি প্রতিহিংসার জন্য আকাশ সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির অপব্যবহার অনেকাংশে দায়ী।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীরা সব সময় দুর্বলকে টার্গেট করে। শিশুরা দুর্বল হওয়ায় লোভ ও স্বার্থের জন্য তাদের হত্যা করা হয়। আগে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ ও প্রতিশোধ নিতে শিশুদের খুন করা হতো। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ছিল। এটি ঘটতো বেশিরভাগ পরিচিতজন ও স্বজনদের দ্বারা। কয়েক বছর ধরে পারিবারিক কলহের জেরে স্বামী-স্ত্রীর হাতে সন্তান খুনের ঘটনা বাড়ছে। পারিবারিক অস্থিরতা ও অসততা এর অন্যতম কারণ। তবে এসব ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে তদন্তও করা হচ্ছে। গ্রেফতার হচ্ছে অপরাধীরা।
মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, প্রতিদিন সারাদেশে শিশুনির্যাতন ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। আমরা আগে জানতাম শিশুরা অপরিচিত লোকের কাছে নিরাপদ নয়। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখছি ভিন্ন। এখন নিজ ঘরেই শিশুদের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে তারা শিশুদের ওপর নির্যাতন বাড়িয়ে দিচ্ছে। আবার মায়েদের নিরাপত্তার কারণে অনেক সময় সন্তানকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। এটি সামাজিক অবক্ষয়। একইসঙ্গে লোভ আমাদের মধ্যে বেড়ে গেছে। অল্প সময়ে বড় হতে চাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। পরকীয়ার কারণও এর মধ্যে রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, পরকীয়ার সম্পর্কটি বাচ্চাটি দেখে ফেলছে, এজন্যও শিশুকে হত্যা করছে।
এলিনা খান বলেন, আমাদের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ একেবারে শেষ হয়ে গেছে। এ ধরনের অপরাধ রোধ করতে হলে সমাজে বড় ধরনের সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে এ বিষয়ে ভূমিকা পালন করতে হবে সবারই।
র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি নিকটাত্মীয়দের হাতে শিশুহত্যার বিষয়টি উদ্বেগজনক। বিষয়টি পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে সচেতনতা জরুরি।
তিনি বলেন, আজকের শিশুরাই আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদের রক্ষায় সমাজের সবার দায়িত্ববান হতে হবে। যারা এসব ঘৃণিত অপরাধ করছে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসছে র্যাব এবং অপরাধমূলক ঘটনা তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, সম্প্রতি বাবা-মায়ের হাতে সন্তানদের খুন হওয়ার ঘটনা বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হলো- এই সময় এসে বাবা-মা সন্তানদের ওপর এত সহিংস হয়ে উঠলো কেন? করোনার এই দুবছরে বিশেষ করে বাবা-মা অভিভাবক ও পরিবারের সিদ্ধান্ত কর্তাদের অনেক ধরনের চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পরিবার সামলানোর ক্ষেত্রে চাপ, অর্থনৈতিক চাপ কিংবা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সামলাতে হচ্ছে। এ কারণে কোনো কোনো সময় বাবা-মা সন্তানদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছে, শাসন করতে গিয়ে নির্যাতনের পরিমাণ বেড়েছে।
‘বাবা-মায়েরা বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে (পরকীয়া) জড়াচ্ছে। এই সম্পর্কের কারণে পরকীয়া যার সঙ্গে হয়, সেই পক্ষ থেকে বিয়ে করার চাপ তৈরি হয়। চাপের ফলে ওই ব্যক্তি নানা ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপের মধ্যে থাকে। নিজের পরিবার ও একটি অবৈধ সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অনেক সময় সন্তানের ওপর ক্ষিপ্ত হয়।’
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, সন্তানদের লালন-পালন করার কৌশলগুলো কী, কীভাবে করতে হয়, এ ধরনের শিক্ষা দেশে একেবারেই নেই। বলতে গেলে পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই কিছু শেখে। যারা অধিক সচেতন বাবা-মা, তারা ইন্টারনেটে কিছু কনটেন্ট দেখে শিখছে। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের বাবা-মা কিংবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাবা-মা তাদের বিষয়গুলো অজানাই থেকে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই শিক্ষক বলেন, শিশু সুরক্ষায় ২০১৩ সালের যে আইনটি রয়েছে, সেটি যদি কার্যকরভাবে সব শিশুর জন্য উপযোগী সমাজ বা পরিবার ব্যবস্থা তৈরি করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে এই আইন অথবা প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে কোনো লাভ নেই।
তিনি আরও বলেন, অভিভাবকদের সচেতন করা, রাষ্ট্রের যে শিশু আইন রয়েছে, সেটি আরও কার্যকর করা, শহর থেকে প্রান্তিকপর্যায় পর্যন্ত শিশুকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রোগ্রাম বা সেবামূলক কার্যক্রম চালু করতে হবে। শিশুনির্যাতন হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। তবে সবার আগে সমাজটাকে শিশুবান্ধব করতে নতুন করে চিন্তা করাটা বেশি জরুরি।