তল্লা মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত প্রতিটি পরিবারই পাঁচ লাখ টাকা করে প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে অনুদান পেয়েছে। আমরাও পেয়েছি সবার মতই। কিন্তু বর্তমানে ঘরে উপার্জনক্ষম বলতে আমার বড় ভাই। তার আয় যথেষ্ট নয় আমাদের পরিবারের জন্য। অনুদানের টাকা ভেঙেই চলতে হচ্ছে প্রতি মাসে। বাবার মৃত্যুর পর অসংখ্য মানুষের সহানুভূতির পাশাপাশি কটূক্তি শোনারও অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনুদান পাওয়ার কিছুদিন পরেই স্থানীয় একজন মন্তব্য করেন-মইরা গেলেই ভালো আছিল, ৫ লাখ টাকা পাইতাম। জবাবে বলি, আমি আপনাকে দশ লাখ টাকা দেই, আমার বাবাকে এনে দেন।
কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জের তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদের ইমাম আবদুল মালেকের ছোট ছেলে ফাহিমুল ইসলাম (২২)। বাবার মৃত্যুর পর হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন তিনি। মাদ্রাসায় ইসলামিক স্টাডিজে অনার্সের পাশাপাশি মুফতি (হাদিস বিশারদ) লাইনেও পড়াশোনা চলছে তাঁর। যদিও করোনার কারণে পড়াশোনায় প্রায় বন্ধ। বায়তুস সালাত মসজিদটি নামাজের জন্য উন্মুক্ত হলে বাবার স্থানটি যেন পান, সে আশাই করছেন তিনি।
তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের এক বছর পর কেমন আছেন ভুক্তভোগীদের পরিবার, তা জানতে কথা বলা হয় মসজিদের ইমাম আবদুল মালেকের পরিবারের সঙ্গে। বাবার গুছিয়ে যাওয়া সংসার সাধ্যমতো চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন দুই ভাই নাইমুল ইসলাম ও ফাহিমুল ইসলাম।
দুর্ঘটনার পর নাইমুল ইসলাম নিজ যোগ্যতায় মডেল ডি ক্যাপিটাল কারখানার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি একাই পরিবারের দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ভাই ফাহিমুল টিউশনি করে নিজের খরচ চালানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও এই পরিবারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু করোনার কারণে সার্কুলার বন্ধ থাকায় সেই চাকরি নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ফাহিম বলেন, ৫ লাখ টাকা অনুদান পাওয়ার পর অনেকেই আর সহায়তা করতে এগিয়ে আসেননি। বাস্তবতা হচ্ছে, যারা চাকরি পাননি তাঁদের এই অর্থ দুই বছরের ভেতরেই শেষ হয়ে যাবে। এরপর তাঁরা কী করবেন কেউ জানেন না। আমরা যারা ভুক্তভোগী আছি তাঁদের সবারই স্থায়ী একটা ব্যবস্থা প্রয়োজন। অনেক পরিবার একমাত্র কর্মক্ষম মানুষকে হারিয়েছেন। ছোট বাচ্চা নিয়ে একা নারী। তাঁদের জন্য ব্যবস্থা করা উচিত। কাজের ব্যবস্থা করে দিলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতাম আমরা।
তিনি আরও বলেন, মুখে মুখে অনেকেই সহায়তা করেছে। আমরা শুনতে পেরেছি এক আমেরিকা প্রবাসী ৩ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু যার কাছে পাঠিয়েছেন তিনি আর কাউকেই দেননি। এরপর শুনতে পেরেছি রূপগঞ্জে বিভিন্ন মসজিদে আমাদের সহায়তা করার জন্য টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সেই টাকাও আমরা দেখিনি। বাস্তবতা হচ্ছে, অনেকেই নাম প্রচারের জন্য সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। বাস্তবে এগিয়ে এসেছেন খুবই কম মানুষ। এ ছাড়া কাতার থেকেও নাকি আমাদের জন্য সহায়তা আসবে। পুরো বছর শুধু শুনেই গেলাম, কবে আসবে তা জানি না।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২৯ আগস্ট এই মসজিদ খুলে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে প্রশাসন। তবে মসজিদটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হবে। সেই মসজিদে ইমাম নিয়োগে অনেকেই আগের ইমামের সন্তানদের চাইছেন। কিন্তু মসজিদ কমিটির কেউ কেউ এতে আপত্তি জানাচ্ছেন।
ঘটনার এক বছর পরে নিজেদের অবস্থা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ফাহিম বলেন, আমার বাবা বিস্ফোরণের পর হেঁটে মসজিদ থেকে বের হয়েছিলেন। তাঁর দেহের ৩৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। ভাবতেই পারিনি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু তাঁর ডায়বেটিস ও হার্টের সমস্যা থাকায় ধকল সহ্য করতে পারেননি। আজ এক বছর ধরে কীভাবে আছি তা আমরাই কেবল জানি। অনেকেই আমাদের পাশে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু সচ্ছল আছে খুবই কম পরিবার। অনেকেই কষ্টে আছেন। তাঁদের যদি একটু স্থায়ী ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় তাহলে উপকৃত হবে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।