〉বাড়ছে বেকারত্ব
〉কর্মক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা
〉যুগোপযোগী সিলেবাস প্রয়োজন
〉অপচয় হচ্ছে সময় ও টাকা
৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) যন্ত্রকৗশলের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস। আর পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী কাজী ফাইজুল করীম। মূলত তারা দুজনই ইঞ্জিনিয়ার।
রফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তিনি চাকরি করছেন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একাউন্স বিভাগে। তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র।
আনিছুর রহমান এমবিবিএস শেষ করে চাকরি করছেন প্রশাসন ক্যাডারে। ইসমাইল হোসেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স শেষ করে চাকরি করছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে। কেবল জান্নাতুল, ফাইজুল, রফিকুল, আনিসুর ও ইসমাইল নয় সারাদেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থী/গ্র্যাজুয়েটদেরই একই অবস্থা। তারা লেখাপড়া করছেন এক বিষয়ে আর চাকরি করছেন অন্য বিষয়ে। ফলে একদিকে যেমন তাদের মেধা কোনো কাজে আসছে না অপরদিকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। কর্মক্ষেত্রেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। নষ্ট হচ্ছে সময় ও অপচয় হচ্ছে টাকা।
একজন শিক্ষার্থীর বিসিএসে চান্স পাওয়া অত্যন্ত গর্বের। তবে যে প্রতিষ্ঠানে প্রকৌশলী হওয়ার জন্য তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে যে তরুণ ভর্তি হয়েছিলেন, সরকার যার পিছনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে এই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে তার প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেলো একই সাথে বঞ্চিত হলো দেশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের অনেক ব্যয় হয়। এছাড়াও বিশেষায়িত শিক্ষা বা কারিগরি খাতে (মেডিকেল, কম্পিউটার সায়েন্স, মেরিন টেকনোলজি, এ্যারোনটিক্যাল এরো স্পেস) শিক্ষার্থী প্রতি সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর পিছনে সরকারের বার্ষিক ব্যয় হয় ২১ হাজার টাকা সেখানে বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির পিছনে সরকারের বার্ষিক ব্যয় সাড়ে ৫ লাখ টাকা। তাহলে শিক্ষার্থীর পিছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করার পরও উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। বিসিএসে উত্তীর্ণ একজন প্রকৌশলী দেশকে সেবা দিতে পারবে ঠিকই তবে তিনি যে শিক্ষায় জ্ঞান অর্জন করেছেন সরকার তার জন্য যে বিনিয়োগ করেছে সে উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। রসায়নে পাস করা রফিকুল ইসলাম চাকরি করছেন ব্যাংকে। তিনি বলেন, পড়াশোনা করেছি রসায়নে আর চাকরি করছি ব্যাংকের একাউন্টন্সে। এতে আমার লেখাপড়া এক্ষেত্রে কোনো কাজে আসেনি। বরং এখানে চাকরি করতে এসে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছি। ব্যাংকিং বিষয়ে না জানার কারণে অনেক সময় নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে। আসলে এক প্রকার বাধ্য হয়েই এই জবটা করছি।
আনিসুর রহমান এমবিবিএস পাস করেও চাকরি করছেন প্রশাসন ক্যাডারে। তিনি বলেন, সুযোগ-সুবিধা ভালো থাকায় প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীর মতে, এক বিষয়ে পড়াশোনা করে অন্য বিষয়ে চাকরি করা যায়। তবে বিশেষায়িত বিষয়ের (ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কম্পিউটার সায়েন্স, মেরিন টেকনোলজি, এ্যারোনটিক্যাল এরো স্পেস) শিক্ষার্থীদের অন্য বিষয়ে চাকরি না করাই উত্তম। এতে করে তিনি যে বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করেছেন বা দক্ষতা অর্জন করেছেন তার দক্ষতা কোনো কাজে আসছে না এবং এসব ক্ষেত্রে অনেক টাকা-পয়সাও ব্যায় হয়। ফলে তার ঐ শিক্ষাটা আদতে কোন কাজে আসে না সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের। কর্মক্ষেত্রে ও নানা জটিলতার সৃষ্টি করে বলে মন্তব্য করেন এই শিক্ষাবিদ। এক্ষেত্রে যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়নের দাবি জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন সব বিষয় যুক্ত করছে, যার সঙ্গে চাকরির বাজারের বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই। ফলে দিনদিন বেড়েই চলছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন।
বিআইডিএস দৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ৫৪টি সরকারি ও বেসরকারি কলেজের ২০১৭ সালে অনার্স (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর মুঠোফোনে জরিপ করে। জরিপে ১ হাজার ৬৩৯ জন শিক্ষার্থী, ২০২ জন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২৩৩ জন চাকরিজীবীর মতামত নেওয়া হয়। যাঁরা বেকার রয়েছেন, তাঁদের ৬২ শতাংশই ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বাইরে অন্যান্য বিভাগের।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্নাতক শেষ করে চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে তাঁরা শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি খোঁজার সুবিধা রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী আছেন ২০ লাখের মতো।
প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন, যার উল্লেখযোগ্য অংশ উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তাদের সবাই চাকরি পান না।
ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা চাকরি প্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা তাদের চাহিদামতো কাজ পাচ্ছেন না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার, যেখানে ভারতে ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেকার রয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। আর সমস্যাটি কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নয়। অন্যান্য পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁরা স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন, তাদের চাকরির বাজারও ভালো নয়। অন্যদিকে আমাদের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার চেয়ারম্যান আ.আ.ম.স আরেফীন সিদ্দীকের মতে, দিনদিন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এখনই যুগোপযোগী সিলেবাস প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তবে তিনি বলেন, কে কোন পেশায় চাকরি বা পড়াশোনা করবে সেটা তার ব্যাক্তি স্বাধীনতা। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যেখানে সুযোগ-সুবিধা ভালো পাবে সেখানেই তো সে চাকরি করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম ফায়েজের মতে, কোন শিক্ষার্থী এক বিষয়ে জ্ঞান নিয়ে অন্য বিষয়ে চাকরি করতে পারবে এ বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কে কোথায় চাকরি করবে সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা। তবে যুগোপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে চাকরি ক্ষেত্রে একটা মেধা তালিকা প্রণয়ন করে সরকারকে সুপারিশ করা। কে কোন বিষয়ে পাস করলো সেটা মুখ্য না। যে পরীক্ষায় ভালো করবে তাকেই আমরা নির্বাচিত করি।