মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে শুধুমাত্র কৃষিকাজ করে ৩৫ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন কৃষাণী নুরুন্নাহার বেগম। কৃষি কাজ করে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ এআইপি পুরুষ্কারসহ বিভিন্ন পুরুষ্কার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০২ সালে স্বামীর অস্বচ্ছল সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা থেকেই তিনি পাশের বাড়ির টেলিভিশনে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান থেকে কৃষি কাজ শুরু করেন। অনেকটা গোপনে একটি এনজিও নিকট থেকে মাত্র ২ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে চাচা শুশুড়ের ১০ কাঠা জমিতে সবজি চাষ করেন। এরপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি নুরুন্নাহারকে।
নিজের কঠোর শ্রম, মেধা ও দক্ষতা দিয়ে একে একে গড়ে তুলেছেন নুরুন্নাহার ডেইরি ফার্ম, গরু, ছাগল ও ভেড়ার খামার, হাঁস, মুরগির, খামার, মাছের খামার। মাঠে চাষ করছেন শীত ও গ্রীষ্মকালিন সবজি ও মসলা। সব মিলিয়ে বিগত বিগত ২০ বছরের ব্যবধানে ভূমিহীন নুরুন্নাহার বেগম কৃষি কাজ করে আজ নিজস্ব ৩৫ বিঘা ও লীজকৃত ১২৫ বিঘা জমির মালিক।
নুরুন্নাহার বেগম কৃষিতে নিজের সাফল্যকে শুধুমাত্র নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। সমাজের দুঃস্থ্য ও অসহায় নারীদের সেবা করার মানসে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালবাসার স্বীকৃতি স্বরুপ তিনি নিজ বাগিতে ”জয় বাংলা নারী উন্নয়ন সংস্থা” নামক একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি সমাজের অসহায় দুঃস্থ্য নারীদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে হাতে কলমে প্রশিক্ষণসহ নানা মুখি কাজ করছে। শুধু তাই নয়, একজন সমাজ কর্মী হিসেসে দেশের প্রায় ১৩০০ নারীকে নিজে জামিনদার হয়ে অগ্রনী ব্যাংক হতে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সেই টাকা দিয়ে প্রত্যেকেই নিজের বাড়িতে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করেছেন।
এছাড়াও প্রতিবন্ধি শিশুদের চিকিৎসার জন্য সিরাজগঞ্জ জেলায় নিজস্ব উদ্যোগে তিনি একটি প্রতিবন্ধি হাসপাতাল গড়ে তুলেছেন। সেখানে বিনা খরচে প্রতিবন্ধি শিশুদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। নিজ এলাকার মানুষ বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের সঠিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ও কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দিতে নিজস্ব তত্ত¡াবধানে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় বাড়ির পাশেই নিজস্ব জমিতে একটি ট্রেনিং সেন্টার ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নির্মানের উদ্যোগ স্বরুপ ভবন নির্মানের কাজ করেছেন। বর্তমানে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, ঘি, মাখন ও পনির উৎপাদন এবং জ্যাম, জেলি ও আচার তৈরীর জন্য একটি আধুনিক মানের প্রজেক্টের কাজ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
কৃষি কাজে সাফল্যের জন্য নুরুন্নাহার বেগম পেয়েছেন অসংখ্য স্বীকৃতিস্বরুপ সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন পুরুষ্কার। দেশের কৃষিতে তিনিই প্রথম সফল নারী হিসেবে ২০২২ সালে কৃষিতে গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তির সম্মাননা স্বরুপ (এআইপি) পদক লাভ করেছেন।
এছাড়া ২০২১ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পদক, জাতীয় সবজি মেলা পুরষ্কার- ২০২০, ফলদ বৃক্ষ রোপণ পুরষ্কার- ২০১৯, জাতীয় সবজি পুরষ্কার- ২০১৮, কেআবি কৃষি পদক- ২০১৭,বঙ্গবন্ধু জাতী কৃষি পদক- ২০১৬(স্বর্ন পদক), শ্রীলংকান হাইকমিশনার কর্তৃক এওয়ার্ড- ২০১৬,শ্রেষ্ঠ জয়িতা পদক- ২০১৬,মাছরাঙ্গা এওয়ার্ড- ২০১৬,বঙ্গবন্ধু জাতী কৃষি পদক- ২০১২(ব্রোঞ্জ পদক),অগ্রনী ব্যাংক কর্তৃক এওয়ার্ড প্রদান- ২০১২,সিটি গ্রæপ জাতীয় কৃষি পদক- ২০১০, ডিএই কর্তৃক ক্ষুদ্র কৃষি উদ্যেক্তা পুরষ্কার- ২০১০, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বর্গাচাষী পদক- ২০০৯, ব্যাংক এশিয়া কর্তৃক পদক- ২০০৯, ঈশ্বরদী উপজেলার শ্রেষ্ঠ চাষী পুরষ্কার- ২০০৮,প্রানী সম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক ক্রেষ্ট প্রদান- ২০০৫ লাভ করেন।
নুরুন্নাহার কৃষি খামারে বর্তমানে চাষকৃত ফসলের মধ্যে স্থানীয় ও উন্নত জাতের বেগুন, গাজর, আলু, লাউ, শিম, ফুলকপি, টমেটো,মুলা, পেঁপে, ব্রোকলি, রেড ক্যাবেজ, ড্রাগন। এছাড়া আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বাদাম, লেবু, লিচুর বাগান রয়েছে।
এআইপি সম্মাননা প্রাপ্ত কৃষাণী নুরুন্নাহার বেগম বলেন, মাটি কখনোই ঘুষ খায় না। মাটি পবিত্র। আমরা মাটিতে পরিশ্রম করি। চাষবাদ করি। মাটি আমাদের পরিশ্রমের মূল্য হিসেবে ফসল প্রদান করে। যা দিয়ে দেশে মানুষের খাদ্য ঘাটতি পূরণে সহযোগিতা করছি। মাটির মতই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের পরিশ্রমের মূল্য দিয়েছেন। সম্মান দিয়েছেন। কৃষক হিসেবে এখন আমি গর্বিত।
নুরুন্নাহার বেগমের স্বামী রবিউল ইসলাম বিশ্বাস বলেন, আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে গর্বিত। আমার স্ত্রী কৃষি কাজ করে আজ সফলতা অর্জন করেছে। দেশবাসীর নিকট আমাদের সকলের মুখ উজ্জল করিয়েছে। কৃষি কাজ আমাদের নিকট গর্বের।