শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার হয়ে ঝড়ে গেলো ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর দুই শিশু শিক্ষার্থীর। শিক্ষকের ভয়ে শিক্ষার্থীরা ও সামাজিক সম্মানের ভয়ে বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া ও লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন ভুক্তভোগির পরিবার। শিক্ষকের শাস্তিরদাবীতে সোচ্চার এলাকাবাসী। তাই পলাতক রয়েছেন সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিক (৪৭)। আর বিগত তিন মাস পুর্বে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও দোষী শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য তদন্ত প্রতিবেদন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রেরণ করতে পারেনি উপজেলা শিক্ষা অফিস। এসব নিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকাবাসীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র অসন্তোষ।
এমনই ঘটনা ঘটেছে ঈশ্বরদী উপজেলার সাহাপুর ইউনিয়নের বাঁশেরবাদা গ্রামের সুতানদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুতানদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর দুই শিশু শিক্ষার্থীকে প্রেম ও বিয়ের প্রলোভন দিয়ে কয়েক দফায় শ্লীলতাহানি ও অনৈতিক কর্ম করে বিগত তিন মাস যাবত পলাতক রয়েছেন মিলন কুমার ভৌমিক (৪৭) নামের এক শিক্ষক। আর লোকলজ্জা ও সম্মানের ভয়ে ভুক্তভোগি দুই শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে পরিবার।
সুতানদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোহেল আহম্মদ সিরাজের লিখিত অভিযোগ, সহকারী শিক্ষিকা ও ভুক্তভোগি শিক্ষার্থীসহ পরিবার ও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্য মতে জানা যায়, ২০২১ সালে এপ্রিল মাসে তৎকালিন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার মুনসুর রহমানের পরামর্শে ঈশ্বরদী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মৃণাল কান্তির নির্দেশে সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিককে সহকারি শিক্ষক হিসেবে সুতানদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রেষণে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
সুত্রমতে, ২২মে/২২ ছুটির সময় জানালা বন্ধ করার সময় সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিক ৪ র্থ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানি করেন। বিষয়টি ওই শিক্ষার্থী অপর শিক্ষকদের জানালে একই বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণীর অপর এক শিক্ষার্থী জানায়, মিলন স্যারতো আমাকে ভালোবাসেন। বিয়ে করবেন। এই জন্য প্রায় আমাকে বিদ্যালয়ের সিঁড়ি ঘরে নিয়ে গিয়ে গায়ে হাত দেন, চুমু খান, আরো অনেক কিছু করেন। আবার আমার মা বাবা অনুপস্থিত থাকলে স্যারকে বাড়িতে ডাকতে বলেন। ওই ছাত্রীর মুখে এসব কথা শুনে শিক্ষক/শিক্ষিকারা হতভ্রম্ব হয়ে পড়েন। এরপর অন্যান্য ছাত্রীরাও শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিকের নানা রকম অপকর্মের কথা প্রকাশ করে। বিষয়টি জানাজানি হয়ে অভিভাবকরা বিদ্যালয়ে এসে হৈচৈ বাধিয়ে দেন। এক পর্যায় শিক্ষক মিলন কুমার পালিয়ে যায়। এরপর বাধ্য হয়ে সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিকের শাস্তি দাবী করে প্রধান শিক্ষক গত ৫জুন/২২ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ করেন।
বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেনীর শিক্ষার্থী ইশা খাতুনসহ অন্যান্যরা জানায়, মিলন স্যার তার বান্ধবীদের গায়ে হাত দেন। তাদের বিয়ে করার কথা বলতেন। স্যার, কেমন কেমন যেনো করতেন। আমরা ভয় পেতাম। তাই ভয়ে প্রথমের দিকে কাউকে কিছু বলতাম না। স্যারের শাস্তি হওয়া উচিত।
সহকারী শিক্ষিকা বিউটি শিরিন, আলমিনা খাতুন জানান, সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিক ইতোপুর্বেও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শ্লীলতাহানি ও অনৈতিক কাজ করার খবর আমরা শুনে ছিলাম। আমাদের বিদ্যালয়ে যোগদানের পর আমরা নিজেরা সতর্ক ছিলাম। কিন্তু কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আবারও এই ধরণের নোংরামি করবেন এটা ভাবতে পারেনি। তবে শিক্ষার্থীদের কাজ থেকে শুনে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছি। এই ধরণের হীন মানুসিকতার মানুষকে শিক্ষকতার পেশায় না রাখা উচিত।
সুতানদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোহেল আহম্ম সিরাজ জানান, সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিক গত ১১ ফেব্রুয়ারি/২০১৭ সালে পাবনা পিটিআই’তে আইসিটি বিষয়ক প্রশিক্ষণে গিয়ে পিটিআই ক্যাম্পাসে পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে গান শোনানোর কথা বলে নির্জন কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন। ভুক্তভোগি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে হওয়া তদন্তে প্রমানিত হয়ে সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত হন শিক্ষক মিলন কুমার। এরপর দীর্ঘদিন পর শিক্ষা অফিস থেকে ক্ষমা করে প্রেরণে আমার বিদ্যালয়ে প্রেষণে যোগদান করান। এখানে এসেও তিনি একই কাজ করেন। তার শাস্তির দাবী করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে অবগত করা হয়েছে। অতি দুঃখের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক জানান, এই ঘটনার পর থেকে ওই দুই ছাত্রীকে তার পরিবার বিদ্যালয়ে আসতে দিচ্ছে না। তাদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছেন। একজন শিক্ষকের কারণে দুটি কোমলমতি শিশুর শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
পাবনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিক শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর থেকেই শিক্ষার্থীদের শ্লীলতাহানির অন্তত ১৩/১৪ টি ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনি শিক্ষক সমাজে একজন স্বীকৃত যৌননিপীড়ক হিসেবে পরিচিত। বারবার একই কাজ করতে তার বিবেকে বাধে না। এসব বলতেও কোনরুপ লজ্জ্বাবোধ করেন না।
সুত্র মতে, শিক্ষক মিলন কুমার মুলত তার যৌনলালসা চরিতার্থ করার জন্য নিরীহ, বাক ও শারিরিক প্রতিবন্ধি, পিছিয়ে পড়া, একই শ্রেণীতে বারবার থাকা গরিব এবং অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সি শিক্ষার্থীদের বেছে নিয়েছেন। এই কারণে তাদের মেয়েদের জড়িয়ে শিক্ষকের এইরুপ কেলেংকারী সমাজে ছড়িয়ে পড়লে বিয়ে হবে না ভেবেই যৌন নিপীড়নের ঘটনাগুলো চেপে গেছেন। আবার শিক্ষার্থীরাও পরিবারের ভয়ে বলতে পারে না।
সহকারি শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার হওয়া দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা জানান, আমরা গরিব মানুষ। আমাদের মান সম্মান ছাড়া আর কিছু নেই। বিদ্যালয়ে গিয়ে সেই সম্মানই যদি শিক্ষকের নিকট হারাতে হয় তাহলে বিদ্যালয়ে গিয়ে লাভ কি ? তাছাড়া মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে। এই জন্য তাদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে দোষী শিক্ষকের যদি দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা শিক্ষা কর্মকর্তারা করতে পারেন তাহলে মেয়েদের পূনরায় বিদ্যালয়ে পাঠানোর কথা ভাবা যাবে বলে জানান ভুক্তভোগি শিক্ষার্থীদের পরিবার।
ঈশ্বরদী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিশুদের শ্লীলতাহানি করা, অনৈতিক কর্মকান্ড অব্যহত রাখার প্রমান পাওয়া গেছে। শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়ক ব্যক্তি শিক্ষকতার মত মহান পেশায় থাকুক তা আমরা চাই না। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রতিবেদন প্রদানের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। একই সঙ্গে সুতানদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগি দুই শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার জন্য যা যা করনীয় তা আমাদের পক্ষ থেকে করা হবে বলেও প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেন এই শিক্ষা কর্মকর্তা।
পাবনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা খন্দকার মুনসুর হোসেনের বদলীজনিত কারণে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে দেওয়া কলও রিসিভ করেননি।
এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মুঠোফোনে অভিযুক্ত সহকারি শিক্ষক মিলন কুমার ভৌমিক বলেন, সবই তো শুনেছেন। আমাকে আবার নতুন করে জিজ্ঞাসা করার কি আছে? আমার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হচ্ছে তাই, মেডিক্যাল ছুটি নিয়ে বাড়িতে রয়েছি।