মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী : প্রতিবছরই রাজশাহীতে ভরা বর্ষাকালে কম বেশি বৃষ্টি হয়। তবে এবার আষাঢ় মাস শেষ হলেও তপ্ত রোদে পুড়ছে পুরো রাজশাহী জেলা। পিচ ঢালা রাস্তার গরম যেন ছিটকে এসে পথচারিদের মুখে তাপ ছড়াচ্ছে। জরুরী কোন কাজ না থাকলে দিনের বেলা মানুষ বাসা-বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না বললেই চলে। তার উপর যোগ হয়েছে ঘনঘন লোডশেডিং। তবে সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ দিনমুজুর আর নি¤œ মধ্যবিত্তদের উপায় নেই পরিবারের লোকজনের অন্যের যোগান দিতে কর্মস্থলে যেতেই হচ্ছে।
চৈত্র কিংবা জ্যৈষ্ঠের টানা তাপপ্রবাহে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে। প্রকৃতির এমন খরায় যেন মধ্য জ্যৈষ্ঠের অগ্নিমূর্তি। পুরো আষাঢ় মাসজুড়ে রাজশাহীতে খুব বেশি বৃষ্টির দেখা মেলেনি। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে বর্ষাকালেও পানি নেই খালবিলে। একারণে রাজশাহীতে পাট কেটে জাগ দেয়া নিয়ে কৃষকরা পড়েছেন চরম বিপাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে বৃষ্টির দেখা না মিললে শত শত হেক্টর জমিতে পাটের বাম্পার ফলন হওয়া সত্বেও পাট জাগ দিতে না পারলে চরম লোকসান গুনতে হবে চাষিদের। রাজশাহী আবহাওয়া অফিস বলছে, গত শুক্রবার (১৫ জুলাই) আষাঢ় মাসের শেষ দিনসহ মাত্র আটদিন বৃষ্টি হয়েছে। এতে গত বছরের থেকে এবার আষাঢ় মাসেই বৃষ্টি কমেছে ৩১৫ মিলিমিটার। আর গত আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হয়েছিলো ২৫ দিন। বৃষ্টিহীন ছিল মাত্র পাঁচদিন। বৃষ্টিপাত হয় ৩৫৪ মিলিমিটার। চলতি বছরে আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র আটদিন যা ৩৯ দশমিক ২ মিলিমিটার। তবে সেটাও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সময়ের জন্য। এ আটদিনের মধ্যে গত ১৮ জুন সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ২০ দশমিক ৯ মিলিমিটার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ২০ জুন, ৯ দশমিক ১ মিলিমিটার। এরপর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩ দশমিক ৬ মিলিমিটারের উপরে ওঠেনি। ২৬ জুন এ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়াও ১৭ জুন ও ২১ জুন দুই মিলিমিটার, ২৪ জুন ০ দশমিক ৪ মিলিমিটার, ৩০ জুন ০ দশমিক ২ মিলিমিটার এবং ৩ জুলাই ১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে গত বছরের চেয়ে এক আষাঢ় মাসেই বৃষ্টি কমেছে ৩১৪ দশমিক ৯৮ মিলিমিটার। রাজশাহী আবহওয়া অফিসের জৈষ্ঠ্য পর্যবেক্ষক গাউসুজ্জামান জানান, রাজশাহীতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত অনেক কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এটা হচ্ছে। কেননা রাজশাহীতে যে পরিমাণ গাছ লাগানো হয়েছে তার চেয়ে কাটা পড়েছে বেশি। আবার নদীর নাব্যতাও কমেছে। সবমিলে জলবায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়াই আবহওয়ার খামখেয়ালিপনা বাড়ছে।
রাজশাহীর পাটচাষিরা বলছেন, পুরো আষাঢ় মাসজুড়ে বৃষ্টি না হওয়ায় রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর, পুঠিয়া, তানোর, বাগমারাসহ বিভিন্ন উপজেলার খালবিলে নদী থেকে পানি প্রবেশ করতে পারেনি। ফলে এসব অঞ্চলের খালবিল প্রায় শুকনো। যার ফলে পাট জাগ দিতে পারছেন না চাষিরা।
পবা উপজেলার দুয়ারি এলাকার পাটচাষি আকবর আলী বলেন, ‘অন্যান্য বছর এই সময় বারনই নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে। কিন্তু এবার বৃষ্টির দেখা না পাওয়ায় এই নদীতে নেই পানি। তাই পাট কেটে জমিতেই স্তুপ করে রাখা হয়েছে। আবার অনেকেই সামান্য পানিতে কচুরি পানা সরিয়ে তার মধ্যেই পাট জাগ দেয়ার ব্যবস্থা করছেন। শুধু পবা উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতেই এমন সমস্যা তা নয়; বরং রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে পানির জন্য হা-হা-কার অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে চাষিরা পাট জাগ দেয়া নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে- ২০২১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে রাজশাহীতে পাট বিক্রি হয়েছিলো- সাড়ে ৫ হাজার টাকা মণ। আর পাট ওঠার শুরুর দিকে ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ বা ২ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। এমন দামের কারণেই প্রতিবছর পাটচাষে বেশি পরিমাণে ঝুঁকছেন চাষিরা। গত বছর পাট চাষ হয়েছিল ১৮ হাজার ১৯ হেক্টর জমিতে। আর ২০২০ সালে ১৪ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে, ২০১৯ সালে ১৩ হাজার ৮৪৬ হেক্টর জমিতে পাটের চাষাবাদ হয়েছিলো। অর্থাৎ প্রতিবছরই পাট চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৮ শত ৮২ হেক্টর হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, ‘চাষিরা পাটের উপযুক্ত দাম পাওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলে দিন দিন পাটচাষ বাড়ছে। জুলাই মাসের প্রথম দিক থেকে জেলার সর্বত্র পাট কাটা শুরু হয়েছে। যা পর্যায়ক্রমে আগষ্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পাট কাটা চলবে। তবে এবার বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় জেলার সর্বত্র ডোবা-নালা,খাল-বিল ও জলাশয়ে পানি না থাকায় পাট জাগ দেয়া নিয়ে বপাকে পড়েছেন কৃষকরা। অনেক কৃষক জমি থেকে পাট কেটে ভ্যান ভাড়া করে ৩/৪ কিলোমিটার দূরে নদীতে ও দূরবর্তী বিভিন্ন জলাশয়ে নিয়ে পাট জাগ দিচ্ছেন। তারা বলছেন বাড়তি পরিশ্রম না করলে লোকশান গুনতে হবে। সবমিলে এবার রাজশাহীতে পাটের বাম্পার ফলন হয়েছে।