〉 ভেসে উঠছে বানভাসি মানুষের লাশ
সিলেট থেকে টুকেরবাজার হয়ে সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে অন্তত ১৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর চোখে পড়বে মাহতাবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র। সেখানে ৭০ বছরের বৃদ্ধ আতর আলী জানালেন, গত তিন দিন ধরে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকলেও ভাত খেতে পারেননি। রবিবার কারা যেন চিড়া আর গুড় দিয়ে গেছেন- খাবার বলতে বৃদ্ধের কাছে এইটুকুই আছে। পানীয় জলের কোনো সংস্থান এখনো হয়নি।
বন্যার পানিই গ্যাস দিয়ে তুলে পান করছেন। এ সময় পাশে থেকে আরজ আলী বললেন, রাত থেকে কিছু খাননি। কারো কাছ থেকে কোনো খাদ্য সহায়তাও পাননি। ছোট ছেলেমেয়েগুলো খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যেতে যেতে পথের ধারে যে কয়টি আশ্রয় কেন্দ্র ও উঁচু জায়গায় মানুষের সমাগম দেখতে পাওয়া গেছে- তার সবকটিতেই ‘ত্রাণের জন্য হাহাকার আর পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারের করুণ আকুতি দেখা গেছে।
শুধু এই আশ্রয় কেন্দ্রই নয়, সিলেটের তিন উপজেলা ও সুনামগঞ্জের আট উপজেলায় এখনো সরকারি ত্রাণই পৌঁছানো যায়নি। ফলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন এসব উপজেলার বন্যাক্রান্তরা। তবে তাদের এমন দুর্দশা নিজের চোখে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ হেলিকপ্টারে সিলেটে আসছেন। তারপর তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকায় ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়নি। অন্যদিকে, চারদিন পর গত রবিবার রাত থেকে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী পৌঁছে শহরে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছে। তবে জেলার শাল্লা, দিরাই, জগন্নাথপুর, মধ্যনগর, তাহিরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় সরকারি ত্রাণ এখনো পৌঁছেনি।
সরজমিন দেখা গেছে, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক থেকে বন্যার পানি নামতে থাকলেও এখনো বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বহু মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে যেতে যেতে রাস্তার দুদিকে চোখে পড়েছে শুধু মানুষের অস্থায়ী ‘আবাস’। আর সড়কের দু’পাশে কেবল পানি আর পানি। আশ্রয় নেয়া বানভাসিরা পানি থেকে উদ্ধারের করুণ আর্তি জানিয়েছেন। কিন্তু অসহায় মানুষের আর্তনাদ আর হাহাকার ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছাচ্ছে না। এদিকে অনেকেই পরিবার-পরিজনের খোঁজখবরও পাচ্ছেন না। ফলে তাদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎকণ্ঠা, চিন্তা আর আর্তনাদ। বেসরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত ১৩ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গতকালই তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছে আমাদের ঈশ্বরদী ডটকম।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ কারণে অসহায় মানুষের কাছে খুব একটা যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি সরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু হওয়া আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া খাদ্যগুদামের আশপাশে পানি থাকায় অনেক ক্ষেত্রে সেখান থেকেও খাদ্যসামগ্রী বের করা সম্ভব হচ্ছে না। আশ্রয় কেন্দ্রে এসেও লোকজন ভোগান্তিতে রয়েছেন। স্থানের তুলনায় এসব আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষের সংখ্যা বেশি। সবমিলিয়ে একদিকে পানিবন্দিরা যেমন খাবার পাচ্ছে না তেমনি আশ্রয় কেন্দ্রে এসেও অনেকের ভাগ্যে খাবার জুটছে না। অভুক্ত অবস্থাতেই আছেন তারা।
তবে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন, রাস্তাঘাটে পানি উঠে যাওয়ায় গত কয়েকদিন সুনামগঞ্জ জেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল। রাস্তা থেকে পানি কিছুটা নেমে যাওয়ায় রবিবার রাতে সিলেট থেকে সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি জরুরি সেবা নিয়ে সুনামগঞ্জে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, অধিকাংশ জায়গায় পানি নামতে থাকলেও এখনো জেলার অনেক স্থানেই মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। অনেক জায়গাতে এক বাসায় চার-পাঁচটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে তাদের কাছে জরুরি সেবা ও ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি জানান, জেলার বিভিন্ন স্থানের ৪৫০টির বেশি অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে এক লাখের বেশি মানুষ অবস্থান করছেন। সুনামগঞ্জ জেলার অধিকাংশ স্থানেই এখনো বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। সীমিত আকারে মোবাইল নেটওয়ার্ক চালু হলেও গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় জেলার সব জায়গায় যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান জাহাঙ্গীর হোসেন। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সেনাবাহিনী জরুরি ত্রাণ বিতরণ ও বন্যা দুর্গতদের উদ্ধার কাজে নিয়োজিত আছে। জেলা প্রশাসক জানান, সেনাবাহিনী মূলত
হাওরসহ অন্যান্য এলাকায় উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে এবং খোঁজ নিচ্ছে পানির কারণে সেসব অঞ্চলে কোথাও মানুষ আটকে রয়েছে কিনা।
সরজমিন সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক : সোমবার সকালে মোটরসাইকেলযোগে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে এগুতেই এই প্রতিবেদকের চোখে পড়ে, রাস্তা থেকে ধীরে ধীরে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে রাস্তার কোথাও কোথাও এখনো কোমর সমান পানি রয়েছে। পানি কমতে শুরু করায় সড়কের বিভিন্ন এলাকায় কিছু দোকানপাটও খুলেছে। মানুষজন রাস্তায় এসে বাজার-সদাই, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনছেন। তবে সুনামগঞ্জ শহরে বেশির ভাগ রাস্তাঘাট এখনো প্লাবিত। এসব সড়কের কোথাও কোথাও হাঁটু, আবার কোথাও কোমর পানি। মধ্য শহরের কিছু বাড়িঘর থেকে পানি নামলেও অন্যান্য এলাকার বাড়িঘর এখনো প্লাবিত আছে। মানুষজন আছেন চরম দুর্ভোগে। মধ্যশহর ছাড়া অন্যান্য এলাকায় এখনো নৌকা ছাড়া অন্য যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। খাবার পানির সংকট রয়েছে সর্বত্র। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় একইভাবে পানি ও খাদ্য সংকট আছে। এর আগে শহরে যেতে যেতে রাস্তা থেকে শুধু পানিই দেখা গেছে। কোথাও কোনো ভূমির দেখা পাওয়া যায়নি।
সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সকালে পৌর শহরের মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে বনানীপাড়া, ষোলোঘর, কাজীর পয়েন্ট, বিহারির পয়েন্ট, হাসপাতাল, ময়নার পয়েন্ট, হুসেন বখত চত্বর, মমিনুল মউজদীন সড়ক, ডিএস রোড হয়ে আলফাত স্কয়ারে সড়কের কোথাও হাঁটু আবার কোথাও কোমর পানি ছিল। সড়কের দুইপাশে অসংখ্য বাড়িঘর, সরকারি বেসরকারি অফিস, দোকানপাট পানিতে ডুবে আছে। শহরের বেশি পানি নতুনপাড়ায়, হাজীপাড়া, সুলতানপুর, কালীপুর, হাসননগর, বড়পাড়া, মোহাম্মদপুর, সুলতানপুর, মরাটিলা, তেঘরিয়া এলাকায়। তবে পানি নামতে থাকায় এরই মধ্যে বেশ কিছু মানুষ নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেছেন। দুপুরে পরে শহরের কিছু অংশে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জে গত মাসের ১৩ তারিখে প্রথম দফায় বন্যা হয়। মানুষ এই বন্যার ধকল সামাল দিতে না দিতেই ১০ জুন থেকে আবার শুরু হয় ভারি বৃষ্টি। একই সঙ্গে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নামে পাহাড়ি ঢল। ১৩ জুন থেকে আবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো। ১৫ মে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা পুরোটাই প্লাবিত হয়। ১৬ জুন পানি প্রবেশ করে সুনামগঞ্জ পৌর শহরে। দুপুর থেকে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরো শহর প্লাবিত হয়ে যায়। রাতে মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকে। রাত পোহানোর আগেই শহর ৫-৬ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। এখন পানি কিছুটা কমেছে। শহর থেকে ধীরে ধীরে পানি নামছে। সঙ্গে মানুষের দুর্ভোগও বেড়েছে।
»পাওয়া যাচ্ছে লাশ : রবিবার সুনামগঞ্জ সড়ক ধরে ২০ শয্যাবিশিষ্ট কৈতক হাসপাতালের সামনে আসতেই জানা গেছে, জাউয়াবাজার কলেজের সামনে থেকে গতকাল দুজনের লাশ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি বাচ্চাও রয়েছে। বানের পানির স্রোতে বাচ্চাটি ভেসে গেছে। খবরটির সত্যতা জানতে জাউয়া বাজারে গ্রামীণ সবজি ভাণ্ডার নামে এক দোকানে গেলে সেটির মালিক মো. ছফেদ আলী পীর বলেন, ‘আমার বোন এবং বোনের তিনটি বাচ্চা। একটি বাচ্চা আমার গলায় ঝুলেছিল। তাকে নিয়ে প্রায় ৪০ মিনিট সাতাঁর কাটছি। সাঁতার কাটতে গিয়ে যখন হয়রান হয়ে গেছি তখন তার চার বছরের বাচ্চাটিকে আমি হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছি। বলেছি, আল্লাহ তুমি জান, আমি জানি না। এরপরে কোথা থেকে একটি নৌকা এসে আমার ভাগনিকে তুলেছে, আমার মাকে তুলেছে, বোনকে তুলেছে। কিন্তু আমাকে আর ধরতে পারেনি। আমাকে স্রোতে ভাসিয়ে আরেকটি বাড়ির আঙিনায় নিয়ে গেছে। সেখানে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় কিছু মানুষ তুলেছে। উলঙ্গ অবস্থায় উদ্ধার করে ওরা আমাকে একটি কাপড় দিয়েছে। পরে অন্যরা গিয়ে আমাকে সেখান থেকে নিয়ে এনেছে। আর যে ভাগ্নিকে পাওয়া যায়নি ওর লাশ আমরা পেয়েছি রবিবার বিকাল ৩টায় কায়স্থকোনা গ্রামের কাছে। পরে নয় বছরের মেয়ে হানিফা বেগমের লাশ এনে দাফন করেছি’। তিনি বলেন, বন্যায় অনেক মানুষ মারা গেছেন। কত সংখ্যক মানুষ মারা গেছেন তার পরিসংখ্যান জানা যায়নি। এছাড়াও জাউয়াবাজারের কাছে ওয়ারিছ আলী নামে আরেকজন প্রবাসী বন্যার পানিতে ভেসে গেছেন। রবিবার তার লাশ পাওয়া যায় জাউয়া ডিগ্রি কলেজের কাছে। সুনামগঞ্জের পাগলা হাইস্কুল এন্ড কলেজ আশ্রয় কেন্দ্রে না খেয়ে স্টোক করে আব্দুল আহাদ নামে একজন মারা গেছেন। তার ভাই ছবকউল্যাহ জানান, বাড়িতে পানি উঠায় দুদিন আগে তারা এই আশ্রয় কেন্দ্রে আসেন। কিন্তু কোনো খাবার পাননি। পাশাপাশি প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাহিল হয়ে যান। পাগলা হাইস্কুল এন্ড কলেজের আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া উত্তর কাদিপুরের রহিমউদ্দিনের স্ত্রী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন।
শান্তিগঞ্জ থানার এসআই তপন কুমার দাশ বলেন, শান্তিগঞ্জে ডুমুরিয়া এলাকায় গত ১৭ জুন বানের পানিতে নৌকা ডুবে যায়। এতে গয়াস মিয়া ও তার স্ত্রী এবং শ্যালিকা নিখোঁজ থাকেন। নৌকাডুবির কিছুক্ষণ পরেই গয়াস মিয়ার স্ত্রীকে উদ্ধার করা গেলেও গয়াস মিয়া ও তার শ্যালিকাকে পাওয়া যায়নি। গতকাল তাদের দুজনের লাশ পুলিশ পানি থেকে উদ্ধার করেছে। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেটের একজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সালুটিকর এলাকায় চারটি মৃতদেহ বানের পানিতে ভেসে যেতে দেখেছেন। ভেসে যাওয়ার এই দৃশ্য তাদের মোবাইলে ভিডিও আকারে ধারণ করা আছে। তারাও পাশে আরেকটি নৌকায় বানের পানি থেকে বাঁচার জন্য নিরাপদ স্থানে যাচ্ছিলেন। এ সময়ই লাশগুলোকে ভেসে যেতে দেখেন। আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন জেলার সদর উপজেলা এবং তাহিরপুর উপজেলায় বানের পানিতে ভেসে যাওয়া এবং বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে ৫ জনের প্রাণহানির খাবর পাওয়া গেছে। তবে প্রশাসন থেকে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।