ঈশ্বরদী উপজেলায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা হঠাৎ আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। যে বয়সে একজন শিশুর বই খাতা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, খেলাধুলা করে নিজেকে বিকশিত করার কথা, সে বয়সে হাতের কাজ শেখার নামে ঈশ্বরদীতে সামান্য মজুরিতে শ্রম বিক্রি করছে।
হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর মিলছে দৈনিক মাত্র ৩০ টাকা!
দরিদ্রতা, অভিভাবকদের শিক্ষার অভাব, অসচেতনতা, অপরিণত বয়সে কঠোর পরিশ্রম, শিশুদের বড় হওয়ার স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এসব শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হচ্ছে।
শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ওয়েল্ডিং কারখানা, গ্যারেজে ঘুরে শিশুশ্রমের এ দৃশ্য চোখে পড়ে।
শিশুর সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা, বিকাশ লাভ করা এবং বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা প্রধান। শিশুর ভবিষ্যতের উপযোগী করে তুলতেই পরিবার হলো প্রধান চালিকা শক্তি। পরিবারের সঙ্গে শিশুদের রয়েছে নিবির সম্পর্ক। পরিপূর্ণ বিকাশ বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন, শিশুদের তা পরিবার থেকে পাবার অধিকার রয়েছে।
জাতিসংঘের শিশু সনদে ১৮ বছরের নিচে ছেলে মেয়েদের শিশু বলা হয়। বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপট বিবেচনা করে অবশ্য ১৪ বছর পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে। শিশুশ্রম সেই সব ছেলে-মেয়েদের কাজ করাকে বোঝায়, যাদের পরিপূর্ণ শারীরিক বিকাশ হয়নি, যাদের আশা, চিত্রবিনোদনের সুযোগের প্রয়োজন আছে। তাদের শিশুশ্রমে নেওয়া যাবে না।
ঈশ্বরদী উপজেলায় পারিবারিক অভাব-অনটন পারিবারিক চাপের মুখে পড়ে শ্রমের বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে ঈশ্বরদীর হাজার হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ। ঈশ্বরদী শহরে বিভিন্ন ওয়েল্ডিং কারখানা, মোটরসাইকেল গ্যারেজে প্রতিনিয়ত এসব শিশু শ্রমিকের মুখ দেখা যায়। কোমলমতি এসব শিশুশ্রমিকেরা বেশিরভাগ গ্রামের দরিদ্র পরিবারের শিশু।
১২ ফেব্রুয়ারি সরেজমিনে ঈশ্বরদী ঈশ্বরদী-পাবনা মহাসড়কের পাশে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রম দিতে দেখা যায়। মোটরসাইকেলের গ্যারেজ থেকে শুরু করে ওয়েল্ডিং কারখানাগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেখা যায়।
ঈশ্বরদী শহরের পোষ্ট অফিস মোড়ের গ্যারেজে কাজ করছেন ১২ বছর বয়সী শিশু সায়েম। সে ঈশ্বরদী সাঁড়া ইউনিয়নের পালিদহ গ্রামের ছেলে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ খুলছেন। সারাদিন সে কাজ করে মজুরি পায় মাত্র ৩০ টাকা। সপ্তাহে ১৫০ টাকা। এছাড়া সকাল বিকেল নাস্তা খেতে দেওয়া হয়।
সায়েম জানান, আরামবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে গতবছর সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। করোনাকালীন সময়ে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। বাবা কৃষকের কাজ করেন। তাই গ্যারেজে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। পড়াশুনা করার ইচ্ছে থাকলেও সংসারে অভাবের কারণে আর সম্ভব হয়নি বলে জানায়।
ঈশ্বরদী শহরের শৈলপাড়া এলাকার ১২ বছর বয়সী শিশু রোহান। বাবা কাঁচামালের ব্যবসা করে। মাদ্রাসাতে পড়াশুনা করতো। আট পারা কোরআন শরীফ মুখস্থ। কিন্তু পরিবার থেকেই গ্যারেজে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বরদী শহরের গ্যারেজ ব্যবসায়ী আজমল হোসেন জানান, করোনাকালীন সময়ে পড়াশুনা বন্ধ হয়েছে। ছোট থেকে হাতের কাজ শিখতে পারলে পারলে হয়ে তাদের কষ্ট করতে হবে না। তাই পরিবার থেকে কাজে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
শিশুদের কাজে কেন নেওয়া হয়েছে? জানতে চাইলে তিনি জানান, কাজ শেখানোর সময় এই শিশুদেরই লাভ। আমাদের লস। আমরা যখন কাজ শিখেছি। আমাদের কেউই কোন টাকা পয়সা দেয়নি। বাড়িতে খেয়ে পড়ে কাজ শিখেছি। ভাড়াটাও পর্যন্ত বাড়ি থেকে দিয়ে দিতো। আমি দুবেলা নাস্তা দেই। দিন শেষে দৈনিক ৩০ টাকা হাতখরচ দেওয়া হয়। যখন সে ২ থেকে ৩ বছর পর পরিপূর্ণ মিস্ত্রি হয়ে যাবে, তখন সে ভালো টাকা আয় করবে।
ঈশ্বরদী শহরের রিকশালক মুন্না খাঁন আক্ষেপ করে বলেন, করোনাকালীন সময় পড়াশুনাতে অমনোযোগীর কারণেই তার ছেলেকে মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজে লাগিয়েছেন। অনেক চেষ্টার পরও যখন ছেলে লেখাপড়াতে মন বসাতে পারেনি, তখন বাধ্য হয়ে গ্যারেজে কাজ শিখাতে পাঠিয়েছে।
ঈশ্বরদীর সচেতন মানুষ মনে করেন, দারিদ্র দূরীকরণ, দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া এবং দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারি সংস্থা ও ঈশ্বরদীর প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনসহ বৃত্তবান লোকেরা আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসলে দারিদ্রপীড়িত অসহায় শিশুরা সুন্দর সুষ্ঠুভাবে বিকশিত হয়ে বেড়ে উঠতে পারবে। ঈশ্বরদী উপজেলা প্রশাসনকে এব্যাপারে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানিয়েছেন ঈশ্বরদীর সচেতন মহল।
(ঈশ্বরদীর বিভিন্ন মোটরসাইকেল গ্যারেজ ও ওয়েল্ডিং কারখানা ঘুরে প্রতিবেদন ও ছবিগুলো তুলেছেন সাংবাদিক টিপু সু্লতান।)