একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। যখন চারিদিক থেকে বিজয়ের খবর আসা শুরু হয়েছে, ঠিক সেসময় ঈশ্বরদীর পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী অভিমুখে আসছিল।প্রতিরোধের চেষ্টা করলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তাদের প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি বাহিনী আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাংক, কামান, জিপ নিয়ে পার হয়ে ঈশ্বরদীর দিকে আসতে শুরু করে।
এমন পরিস্থিতিতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেসময় ভারতীয় মিত্র বাহিনীর স্থানীয় কমান্ডারের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সহযোগিতা চায়। সেদিন বেলা ১২টার দিকে পদ্মা নদীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিয়ে ভারতীয় যুদ্ধ ‘বোমারু বিমান’ উড়তে দেখা যায়।
দুপুর ১২টায় পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে ভারতীয় পাঁচটি যুদ্ধবিমান চক্রাকারে ঘুরছিল। হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল যুদ্ধ বিমান থেকে বোমা হামলা। পরপর চার-পাঁচটি বোমা হার্ডিঞ্জ ব্রিজে নিক্ষেপ করে ভারতীয় মিত্রবাহিনী। মিত্রবাহিনীর একটি বোমার আঘাতে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ৯ ও ১৫ নম্বর স্প্যান সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ১২ নম্বর স্প্যানের পশ্চিম দিকের মাথা ভেঙে পদ্মা নদীতে পড়ে যায়। আরেকটি বোমা রেললাইনের মাঝখানে পড়ে পাকশী রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই বড় দুটি গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। বিশালাকার আকৃতির আরেকটি বোমা পড়েছিল পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে ৫০ গজ দূরে, পশ্চিমের বালুরচরের মাঝে। উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের সমস্ত রেলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমান কয়েকটি বোমা নিক্ষেপ করেছিল।
বিশালাকার সেলটি সেদিন অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়েছিল। বিমান থেকে বালুর ওপরে পড়ার কারণে বিস্ফোরিত হয়নি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে সেনাবাহিনীকে নিয়ে বালুর ভেতর বোমা বিস্ফোরণ ঘটনো হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বোমার খোলস আজও পাকশীর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) কার্যালয় এর সামনে লোহার নিরাপত্তাবেষ্টনীতে সংরক্ষণ করে রেখেছেন পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। যা আজও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের সহযোগিতায় স্প্যানটি নির্মাণ করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের জাহাজ উদ্ধারকারী কোম্পানি সেলকো দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্প্যানের উদ্ধারকাজ করার সময় ঝুলে থাকা স্প্যান ভেঙে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও স্প্যান এতটা ভারী ছিল যে নদী থেকে তোলা সম্ভব হয়নি। সহযোগী দেশ হিসেবে ভারতীয় প্রকৌশলীরা আরেকটি স্প্যান তৈরি করলেও বৃট্রিশ আমলে নির্মিত ব্রিজের মত ডিজাইন না হওয়ায় পরে মূল নকশার মতই বৃট্রিশ আমলের প্রকৌশলীদের আদলে ১২ নম্বর স্প্যান প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ১২ নম্বর স্প্যানে ইতিহাস হয়ে লেখা রয়েছে সেই তথ্য।
তৎকালীন পাবনা অ্যাডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক (এজিএস) বর্তমান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশীদুল্লাহ অনুভূতি জানিয়ে বলেন, সেদিন (১৪ ডিসেম্বর) যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে ঈশ্বরদীর দিকে আসছিল। আমরা (মুক্তিযোদ্ধারা) বাঘইল গ্রামের পাকশী পেপার মিলের ইয়ার্ডে অবস্থান করছিলাম। সারিবদ্ধভাবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে হেঁটে আসছিল ওরা (পাক-হানাদারবাহিনীরা) রেললাইনের ওপর দিয়ে। আমরা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়ে রেললাইনে উঠে অবস্থান নিয়ে আত্মসমর্পণ করার কথা বলতেই পাকসেনারা আমাদের দেখে বলতে থাকে ‘এ্যাহ- সালা বাঙালি হ্যায়’ (এই তো বাঙালি) বলেই সরাসরি বৃষ্টির মত গুলি ছুড়তে থাকে। আমরাও (মুক্তিযোদ্ধারা) তাদের পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করি। ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের ওপর মারাত্মক আক্রমণ শুরু করে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে সেসময় তারা ট্যাংক, কামান জিপ নিয়ে পার হতে থাকে।
উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশীদুল্লাহ আরও বলেন, সেদিন বেঈমান পাকসেনাদের ওপর কোনো বিশ্বাস ছিল না। মনে হয়েছিল উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যদি চলে যায়? ওই পরিস্থিতিতে আমরা (মুক্তিযোদ্ধারা) ভারতের মিত্রবাহিনীর স্থানীয় কমান্ডারের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিমানবাহিনীর সহযোগিতা চাই। দুপুর ১২টায় উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতেই সেদিন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর চার-পাঁচটি যুদ্ধবিমান হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর চক্কর দিয়ে বিমান থেকে চার-পাঁচটি বোমা নিক্ষেপ করেছিল।
পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ বিধ্বস্ত হওয়ার পরে সাত বছরের এক শিশু, বর্তমানে পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ প্রচার সম্পাদক জহুরুল মালিথা অনূভূতি জানিয়ে বলেন, বিকট আওয়াজ শুনার পর থেকেই কেন যেন একটা কৌতুহল ছিল। সেদিন শৈশবের দূরন্তপনায় পাকশী স্টেশনে এসে দেখি, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের গার্ডার ভেঙে পড়ে রয়েছে। পাকিস্তানী হানাদারবাহিনীর ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংক ব্রিজের ওপরই পড়ে রয়েছে। কয়েকটি পাকসেনার মরদেহ হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ভাঙা গার্ডারে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল।
সেদিন পাকশী স্টেশনের পাশে একটি শেল পড়ে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। আরেকটি বিশালাকার শেল পড়েছিল, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বালুচরে। শেলটি অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে ছিল। বিমান থেকে বালুর ওপর পড়ায় বিস্ফোরিত হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সেনাবাহিনী সদস্যরা বালুর ভেতরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে করে একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটনো হয়। বোমার খোলসটি আজও পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের প্রধান দফতরের কার্যালয়ের সামনে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলছে।
পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে প্রকৌশলী-২ আব্দুর রহিম অনূভূতি জানিয়ে জানান, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যই স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করতে সেসময় বোমার আঘাতে ব্রিজটি ভেঙে ফেলার দরকার ছিল। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় দেশে রেলওয়ের যোগাযোগ রক্ষার স্বার্থে ১৯৭৫ সালে তৎকালীন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টা ও প্রচেষ্টায় ভারত সরকারের প্রকৌশলীদের সহযোগিতায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আদলে আরেকটি গার্ডার প্রতিস্থাপন করা হয়। পরে ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট হার্ডিঞ্জ রেলসেতুর ওপর দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল। যা ছিল বিজয়েরই আরেকটি অবিস্মরণীয় জয়।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশীর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহীদুল ইসলাম জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধ-কিংবা মুক্তিযুদ্ধের যেকোনো স্মৃতি সামনে এলে হৃদয় অনেকটা উদ্বেলিত হয়।
ডিআরএম শাহীদুল ইসলাম আরও জানান, স্বাধীন বাংলার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এদেশে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আজ আমাদের হৃদয়টা গর্বে ফুলে ওঠে।