‘ওরা মাছটা কেনে, কল্লাটা নেয় না। মাংস কেনে হাড্ডি ছাড়া। তাতে দাম যত বেশি হোক না কেন, সেইটেই দেয়। এতে কইরে আমরা লোকালরা (স্থানীয়রা) পড়ছি বিপদে। কথাগুলো বলছিলেন ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান। তাঁর আফসোস আগের মতো তিনি আর মাছ, মাংস, ফলমূল কিনতে পারেন না। কারণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করা বিদেশিদের জন্য গড়ে ওঠা গ্রিন সিটিকে ঘিরে ওই এলাকার বাজারে সবকিছুরই এখন দাম বেশি।
গ্রিন সিটিতে পাঁচ হাজারের বেশি বিদেশির আবাস। এর মধ্যে রুশ প্রায় তিন হাজার। এ ছাড়া রয়েছেন কাজাখস্তান, বেলারুশসহ আরও কয়েকটি দেশের নাগরিকেরা। বিপুলসংখ্যক বিদেশির আগমনে বদলে গেছে রূপপুর। উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে সবকিছুতেই। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিদেশিরা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশছেন, একে অন্যের ভাষা শিখছেন। গড়ে উঠছে বন্ধুত্ব। তবে এত কিছুর মধ্যেও স্থানীয়দের আছে কিছু অভিযোগও।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বিশ্বাস বললেন, বিদেশিদের দোভাষী হিসেবে কাজ করা অনেকেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন। তিনি এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু লিখিত অভিযোগও পেয়েছেন। এ ছাড়া বাজারে দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও তাঁর নজরে পড়েছে। এ জন্য তিনি বাজারে মাইকিং করে দাম সহনশীল রাখার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে তেমন একটা কাজ হয়নি।
এনামুল হক বিশ্বাস এ-ও জানালেন, বিদেশিদের কারণে কিছু সমস্যা তৈরি হলেও সার্বিকভাবে রূপপুরের উন্নয়ন হচ্ছে। বিদেশিদের চাহিদা মেটাতে নতুন নতুন দোকান, রেস্টুরেন্ট, হোটেল তৈরি হচ্ছে। বছর পাঁচেক আগেও যে জায়গাটায় ৫০টির মতো দোকান ছিল, সেখানে এখন পাঁচ শতাধিক দোকান।
সেলুন থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার—সব জায়গাতেই কর্মচারীরা কম-বেশি রুশ ভাষা শিখে নিয়েছেন
সরেজমিনে দেখা গেল, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, রেস্তোরাঁ সব মিলিয়ে রূপপুর এখন আর গ্রাম নেই, হয়ে উঠছে আধুনিক এক শহর। আর এই আধুনিক শহরে রুশ প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। রুশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়েছে। সাইনবোর্ডগুলোতে বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি রুশ ভাষাও লেখা আছে। রাশিয়ানদের রুচি ও চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে দোকানপাটে পণ্য তোলা হচ্ছে। সেলুন থেকে শুরু করে কাঁচাবাজার—সব জায়গাতেই কর্মচারীরা কম-বেশি রুশ ভাষা শিখে নিয়েছেন। এমনকি ভিক্ষুকেরাও রুশ ভাষায় ভিক্ষা করছেন।
রূপপুর ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে কয়েকটি রুশ ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানে তরুণদের উপচে পড়া ভিড়। রুশ ভাষা শিখতে আগ্রহী হচ্ছেন মধ্যবয়সী, এমনকি প্রবীণেরাও। ‘রুশ ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার’ নামের একটি কোচিং সেন্টারে এই ভাষা শেখা ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি ব্যবসায়ের প্রয়োজনে রুশ শিখেছি। আমার দোকান এবং রেস্টুরেন্টে যারা কাজ করছে, তাদেরও রুশ শেখানোর চেষ্টা করছি। কারণ, আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রুশরাই বেশি আসে।’
রুশ ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টারে কথা বলে জানা গেল, তারা দিনে চারটি ব্যাচে রুশ ভাষা শেখাচ্ছে। একেকটি ব্যাচে গড়ে ২০ জন করে শিক্ষার্থী। তিন ও ছয় মাস মেয়াদি দুটি কোর্সে এই ভাষা শেখানো হয়। মাসে দিতে হয় আড়াই হাজার করে টাকা।