শারদোৎসবে মাতোয়ারা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষ। আজ সোমবার ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে সূচনা ঘটছে বাঙালীর শারদোৎসব। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। তবে এবারও মহামারী করোনা সেই উৎসবে কিছুটা হলেও ছেদ ঘটিয়েছে। তবুও নিয়ম মেনেই প্রতিটি মন্ডপেই আধুনিক থিমের সঙ্গে ডিজিটাল আলোকসজ্জায় উদ্ভাসিত চারিদিক। আজ শুরু হয়ে আগামী ১৫ অক্টোবর শুক্রবার প্রতীমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসব। কাল মঙ্গলবার মহাসপ্তমী।
ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি, আর ভক্তকূলের আবাহনের মন্ত্রোচ্চারণে দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন ঘটেছে। পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, মন্দিরে মন্দিরে ধূপ-ধুনোয় ভক্তদের নৃত্য আরতি, আর ঢাক-ঢোল, কাঁসর-মন্দিরার পাশাপাশি মাইকের আওয়াজ আর বর্ণাঢ্য আলোকচ্ছটায় আজ সারাদেশের পূজামন্ডপগুলো উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে।
দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনে দুর্গতিনাশিনীর আগমন আনন্দে বিহ্বল বিশ্বের কোটি হিন্দু সম্প্রদায়। প্রতিমা তৈরি শেষ। বাহারি রঙ চড়েছে প্রতিমার গায়। নিপুণ শিল্পী তার তুলির আলতো ছোঁয়ায় জাগিয়ে তুলেছেন মা দুর্গাকে। জেগে উঠবেন সরস্বতী। গনেশের গায় উঠেছে নকশীদার কুচির দুধসাদা ধুতি। মা লক্ষ্মীর হাসি ঝরে পড়ছে মন্ডপগুলোতে। আজ ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে খুলে যাবে মা দুর্গার সিগ্ধ শান্ত চোখ। জেগে উঠবেন দশভুজা। আশীর্বাদ দেবেন মনোবাঞ্ছা নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পূজারীকে।
তবে করোনার সংক্রমণ এড়াতে গতবছরের মতো এবারও সারাদেশের পূজামন্ডপগুলোতে বাড়তি সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই দুর্গোৎসব আয়োজিত হবে। পূজার আয়োজনকে ঘিরে নানা বিধিনিষেধের কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে এরইমধ্যে। গতবছরের মতো এবারও দুর্গাপূজায় উৎসব সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো পরিহার করে সাত্ত্বিক পূজায় সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ। বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জা যেমন থাকবে না, তেমনি বিসর্জনের শোভাযাত্রাও এবার হবে না।
দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এসেছেন বিশ্ব শান্তির জন্য তথা সবার মঙ্গলের তরে। কিন্তু অসূরবিনাশিনী জগজ্জননী দেবী দুর্গা বাঙালীগৃহে আসেন অন্যভাবে। কৈলাশ ছেড়ে প্রতিবছর তিনি আসেন বাবার বাড়িতে কন্যারূপে। দেবী দুর্গার সঙ্গে প্রতি শরতে মর্ত্যে আসেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। এই চালচিত্রে দেবাদিদেব শিবও বাদ যান না। লক্ষ্মী সমৃদ্ধি ও সরস্বতী জ্ঞানের প্রতীক। কার্তিক হচ্ছেন দেবসেনাপতি, শত্রুনাশকারী। আর গণেশ হচ্ছেন সর্বসিদ্ধিদাতা অর্থাৎ মানুষের কামনা পূরণকারী। বাঙালী হিন্দুরা যে কোন শুভ কাজে ইষ্টনাম হিসেবে দেবী দুর্গাকে স্মরণ করে থাকেন।
পূরাণ মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তে তিনি পূজার আয়োজন করায় দেবীর এ পূজাকে বাসন্তী বলা হয়। কিন্তু রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কা যাত্রার আগে শ্রী রামচন্দ্র দেবীর পূজার আয়োজন করেছিলেন শরৎকালের অমাবস্যা তিথিতে, যা শারদীয় দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। দেবীর শরৎকালের পূজাকে এজন্যই হিন্দুমতে অকাল বোধনও বলা হয়।
সনাতম পঞ্জিকা মতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে স্বর্গালোক থেকে মর্ত্যালোকে (পৃথিবী) আসবেন। যার ফল হচ্ছে ফসল ও শস্যহানি। দেবী স্বর্গালোকে বিদায় (গমন) নেবেন দোয়ায় (পালকি) চড়ে। যার ফল হচ্ছে মড়ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ ও মহামারীর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে।
এর আগে গত ৬ অক্টোবর দেবী দুর্গার আবাহন বা মহালয়ার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় দেবীপক্ষের। সাধারণত দেবীপক্ষ শুরুর সাতদিন পর পাঁচদিনের দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে থাকে। তবে এবার পঞ্চমীর বোধন ও ষষ্ঠী তিথি একইদিনে পড়ায় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরুর দিনক্ষণও একদিন এগিয়ে এসেছে। আজই সায়ংকালে তথা সন্ধ্যায় বোধনের মাধ্যমে দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙ্গার জন্য বন্দনা পূজা করা হবে।
এর আগে ষষ্ঠী তিথিতে সকাল ৭টা ৩১ মিনিটের মধ্যে দেবী দুর্গার ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হবে। পরে সন্ধ্যায় বোধন শেষে দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হবে মূল দুর্গোৎসব। আগামীকাল মঙ্গলবার মহামপ্তমী, বুধবার মহাষ্টমী, বৃহস্পতিবার মহানবমী এবং শুক্রবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন অনুষ্ঠিত হবে।