বুধবার , ২৪ নভেম্বর ২০২১ | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. আইন ও আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. ঈশ্বরদী
  5. করোনাভাইরাস
  6. কৃষি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খেলাধুলা
  9. গল্প ও কবিতা
  10. চাকরির খবর
  11. জাতীয়
  12. তথ্যপ্রযুক্তি
  13. নির্বাচন
  14. পাবনা
  15. ফিচার

ঈশ্বরদী-ব্রিটিশদের শহরে রুশদের দাপট

প্রতিবেদক
বার্তা কক্ষ
নভেম্বর ২৪, ২০২১ ৫:০৯ অপরাহ্ণ

ঈশ্বরদীতে বর্তমানে ব্রিটিশ স্থাপনার অধিপত্য ম্রিয়মাণ। নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কেন্দ্র করে ব্রিটিশদের গড়া শহরটি পড়লে যাচ্ছে রাশিয়ানদের পদচারণে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ইমারত, হাসপাতাল, রিসোর্ট, বিনোদনকেন্দ্র, বিপণিবিতান সহ নানা স্থাপনা। যে বদল এর ছোঁয়া লেগেছে পুরো ঈশ্বরদী উপজেলায়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে অনেকের।ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় যাতায়াত সহজ করতে ব্রিটিশদের শাসনকালে পদ্মা নদীর দক্ষিণের দামকুদিয়া ঘাট থেকে উত্তরে সাঁড়া ঘাট ( বর্তমান ঈশ্বরদী) পর্যন্ত রেল সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯১৯ সালে শুরু হয় হার্ডিং ব্রিজের নির্মাণ কাজ।

এই সময়ই ঈশ্বরদীতে নির্মিত হয় দেশের প্রথম রেলওয়ে জংশন স্টেশন, রেলওয়ে কার্যালয়, কোয়ার্টার সহ নানা স্থাপনা। ১৯১৫ সালে একযোগে চালু হয় হার্ডিং ব্রিজ ও রেলওয়ে জংশন। ব্রিটিশদের হাত ধরেই নতুন রূপে সাজতে থাকে ঈশ্বরদী উপজেলা। তৈরি হয় ঈশ্বরদী বিমানবন্দর।নিভৃত এক পল্লী পরিণত হয় আলোকোজ্জ্বল শহরে।


স্থানীয় লোকজন বলেন, ব্রিটিশ আমলে পুরো এলাকাটি ছিল জঙ্গলময়। দিনের আলোতে ও এখানে মানুষ চলাচল করতে ভয় পেত। প্রথম ব্রিটিশরাই এলাকাটি পরিষ্কার করেছিলেন। দক্ষিণের সাথে উত্তরের যোগাযোগ সৃষ্টি করতে তাঁরা তৈরি করেছিলেন রেললাইন সহ বিভিন্ন স্থাপনা। বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার রাশিয়ানদের পদচারণে মুখর পুরো এলাকা।


ইতিহাস : সেই আইয়ুব খানের আমলে, ১৯৬১ সালে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কোথায় হবে সে বিদ্যুৎকেন্দ্র? ঠিক হয় পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদীর তীরে রূপপুরে হতে পারে এটি। কিছু কিছু কাজ চলে, জমি অধিগ্রহণ করা হয়, কিন্তু ১৯৬৯-৭০ সালে পাকিস্তান সরকার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সে প্রকল্প বাতিল করে দেয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এরপর নানাভাবে নানা গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা বলেন, হ্যাঁ এখানে, পাকশীর রূপপুরেই গড়ে উঠুক বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

২০১১ সালের ২ নভেম্বর বাংলাদেশ ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত আন্তরাষ্ট্রীয় সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া সফরকালে রাশিয়ার সঙ্গে নির্মাণকাজের প্রস্তুতিপর্বের কাজ সম্পাদনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর পরের বছরগুলোতে প্রয়োজনীয় সব কাজ সম্পন্ন হয়।

বিদ্যুৎকেন্দ্র ছেড়ে দৃষ্টিনন্দন কয়েকটি বাস চলে গেল গ্রিন সিটির দিকে, তাতে যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা রুশ দেশের নাগরিক। এসেছেন বাংলাদেশের এই পারমাণবিক কেন্দ্রে কাজ করতে। আমরা যাঁরা আদার ব্যাপারী, তাঁরা এই জাহাজের খবর না নিয়ে বরং সেই তারিখটাকে মনে রাখি, যেদিন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিটের প্রথম কংক্রিট ঢালাই উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারিখটি ছিল ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর। সেদিন থেকেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পথে পা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ।

পাকশীর রূপপুর পাকার মোড়ে গড়ে উঠছে যে বিশাল স্থাপনা, তার গভীরে যেতে হলে পাকশীর জনজীবন নিয়েও জানা থাকা দরকার। বহু আগে যখন এই এলাকা অধিগ্রহণ করা হয়, তখন উচ্ছেদ হওয়া মানুষের ঠাঁই হয়েছিল যেখানে, তারই নাম নতুন রূপপুর। ষাটের দশকের মাঝামাঝি গড়ে ওঠে নতুন রূপপুর। আর এই রূপপুর তখন থেকেই প্রস্তুত হয় একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।

তারও অনেক আগে কলকাতার সঙ্গে আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড আর উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ সহজ করার জন্য পদ্মা নদীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ব্রিজটি ১৯১০ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ অবিভক্ত ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিজটির উদ্বোধন করেছিলেন। ব্রিজের নামও দেওয়া হয়েছিল তাঁর নামেই, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।

রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন শ্রমিকেরা।

এর পর থেকেই ভারতবর্ষের নানা জায়গার মানুষ এসে পাকশীতে বসবাস করতে থাকেন। তা থেকে ঋদ্ধ সংস্কৃতির জন্ম হয় এখানে। ১৯০৪ সালে গড়ে ওঠে পাকুরিয়া স্কুল। ১৯১৮ সালেই দুটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকশীর মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক চেতনার প্রকাশ ঘটাতে থাকে। স্কুল, কলেজ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, অফিসপাড়ায় মিশ্র সংস্কৃতি—সবকিছু মিলিয়ে এখানে যে জনবসতি গড়ে ওঠে, তা এলাকাটিকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তবে, দেশের অন্যান্য জায়গার মতো এই এলাকাও ছিল কৃষিপ্রধান। বেশির ভাগ মানুষ কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। চর এলাকায় যে ফসল হতো, তার একটা ছিল আখ। সুগার মিলে আখের চাহিদা পূরণের পথে অনেকটা অবদানই ছিল পাকশীর। এখন অবশ্য আখে ভাটার টান।

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে পাকশীর পরিবেশে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সংস্কৃতি সংগঠক আবুল কালাম আজাদ পাকশী বাজারের রেইনট্রির নিচে একটি লোহার টেবিল ঘিরে থাকা চেয়ারে বসে বলতে থাকেন সেই রূপকথার গল্প। বিশদে সে বর্ণনা থাকবে। এখানে শুধু কয়েকটা তথ্য বলে রাখা যাক। আমরা অনেকেই দর্শনির বিনিময়ে নাটকের কথা বলতে গিয়ে রাজধানী ঢাকার কথা বলি। কিন্তু পাকশীতেই হাফিজউদ্দিন মুনশি ১৯৪৬ সাল থেকেই দর্শনির বিনিময়ে নাটক করে এসেছেন। পাকশী বাজারের কাছে অফিসপাড়ায় সবুজে ছাওয়া উদ্যানের পাশে যে হাশেম আলী মিলনায়তন আছে, সেটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯১৬ সালে।

কৃষিপ্রধান এই এলাকাটির প্রথমে যদি চেহারা বদলে দিয়ে থাকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, তাহলে এবার আমূল বদলে দিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে এখনই পুরো পাকশীতেই সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে, এটা বললে ভুল হবে। যেসব জায়গায় বিদেশিদের বসবাস, তার আশপাশে সূচনা হয়েছে নতুন দিনের। বেকার যুবক পেয়েছেন চাকরি কিংবা ব্যবসার সন্ধান, কেন্দ্রে মালামাল জোগানের জন্য তৈরি হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকেই এখানে এসেছেন ব্যবসার স্বার্থে। রুশদের সঙ্গে আলাপ-সালাপ করে তাঁরা দিব্বি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

ভাষাতত্ত্বে বলা হয়, যেখানে একসঙ্গে এক ভাষাভাষী বহু মানুষের বসবাস, সেখানে অন্য ভাষাভাষীরাও সে ভাষা শিখে ফেলে দ্রুত। রূপপুরের গ্রিন সিটি সেই তত্ত্বের সফল পরীক্ষাগার। বাঙালিদের কেউ রুশ ভাষা শিখছে পেটের দায়ে, কেউ শিখেছে রুশদের মন জয় করবে বলে, কেউ বন্ধুত্বের খাতিরে। এখানে এমন অনেক বাঙালি বিশেষজ্ঞ কাজ করছেন, যাঁরা পড়াশোনা করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নে, যার প্রতিনিধি আজকের রাশিয়ান ফেডারেশন। প্রকল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাঁরা কাজ করে থাকেন। শ্রমিকদের রুশ ভাষা না জানলেও চলে। তাঁরা শুধু ওপরের নির্দেশ মেনে কাজ করেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করে নিম্নবিত্ত অনেক মানুষেরই ভাগ্য খুলে গেছে। তাঁদের চেহারায় সমৃদ্ধির ছোঁয়া। সাইকেল থেকে মোটরসাইকেলে উত্তরণকে তারই একটি সূচক হিসেবে ধরা হলে বোধ করি ভুল বলা হবে না।

গ্রিন সিটির রেস্তোরাঁগুলো নিয়ে আলাদাভাবে বলতে হবে। এখানে কেউ কেউ রুশ খাবার পিলমিনি (অনেকটা নেপালি খাবার মোমোর মতো) তৈরির কারখানাও বানিয়েছেন। সুদৃশ্য প্যাকেটে সেই খাদ্য বিক্রিও হচ্ছে গ্রিন সিটির মধ্যে থাকা দোকানগুলোয়।

সর্বশেষ - ঈশ্বরদী

দুঃখিত,এই ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি কপি করা নিষিদ্ধ