সোমবার , ৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. আইন ও আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. ঈশ্বরদী
  5. করোনাভাইরাস
  6. কৃষি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খেলাধুলা
  9. গল্প ও কবিতা
  10. চাকরির খবর
  11. জাতীয়
  12. তথ্যপ্রযুক্তি
  13. তারুণ্য
  14. ধর্ম
  15. নির্বাচন

পাবনা সুগার মিল : সচল করতে যৌথ পার্টনারশিপের পরিকল্পনা

প্রতিবেদক
আমাদের ঈশ্বরদী রিপোর্ট :
অক্টোবর ৯, ২০২৩ ৮:৫৮ অপরাহ্ণ

৩ বছর আগেও যেখানে ছিল কর্মচাঞ্চল্যতা আর মানুষের কোলাহল, সেই পাবনা সুগার মিল এখন যেন ভুতুড়ে এলাকা। আখ বহনকারী গাড়িগুলো মরিচা ধরে অলস পড়ে আছে। পুরো এলাকা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা পাবনার এই সুগার মিলকে বাঁচাতে যৌথ পার্টনারশিপের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক পার্টনারশিপে চালুর ব্যাপারে চেষ্টা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

পাবনা চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অর্থায়নে পাবনার ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়ায় ৬০ একর জমির ওপরে প্রতিষ্ঠা করা হয় পাবনা সুগার মিল। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্থাপনের কাজ শুরু হয় হলেও ১৯৯৬-৯৭ সালে মাড়াই মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। পরের বছর ১৯৯৭-৯৮ মৌসুম থেকে বাণিজ্যিকভাবে মাড়াই মৌসুম চালু করে কারখানাটি। তবে উৎপাদন শুরুর পর থেকেই লোকসান গুনতে থাকে সুগার মিলটি। মিলটির দৈনিক আখ মাড়াই করার ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন এবং বার্ষিক উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার মেট্রিক টন। আখ চাষি, সুগার মিল শ্রমিক-কর্মচারীসহ নানামুখী আন্দোলন আর সংকটে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর দেশের বেশ কয়েকটি চিনি কলের সঙ্গে পাবনা সুগার মিলেও আখ মাড়াই কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে শিল্প মন্ত্রণালয়।

পাবনা চিনিকলের ১০টি আখ উৎপাদন জোন ছিল। বন্ধ হওয়ার পর চারটি জোনকে পাশের নর্থবেঙ্গল সুগার মিলে এবং বাকি ছয়টি জোনকে নাটোর চিনিকলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সবগুলো জোনেরই আখ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। আখ মাড়াই প্ল্যান্টসহ চিনিকলে প্রায় ৮০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় মাড়াই যন্ত্রের ডোঙ্গা, নাইফ, ক্রাসার, বয়লার হাউজ, রুলার, ড্রায়ারসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে।

মিলটি বন্ধের সময় ৪০০ কোটি টাকা বকেয়া থাকলেও বর্তমানে এই টাকা বেড়ে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা হয়েছে। মিলটিতে স্থায়ী, অস্থায়ী ও মৌসুমভিত্তিক শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ২০০ জন। তাদের অনেককে চলমান অন্য চিনিকলে বদলি করা হয়েছে। কেউ কেউ পেশা বদলে চলে গেছেন অন্য পেশায়। মিলে বর্তমানে ১০ জন কর্মকর্তা, ১৭ জন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ও ৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী আছেন।

সরেজমিনে পাবনা সুগার মিলে গিয়ে দেখা গেছে, এক সময়ের কর্মচাঞ্চল্যকর মিলের হাজারো শ্রমিক-কর্মচারীদের পদচারণে মুখরিত এলাকায় এখন সুনসান নীরবতা। নেই কোনো মানুষ। শুধু উৎপাদন এরিয়াতে যন্ত্রপাতি পাহাদার হিসেবে দু-একজন প্রহরী বসে আছেন। চিনিকল ও গোডাউন তালাবদ্ধ। খোলা আকাশের নিচে মরিচা ধরে পড়ে আছে টন টন আখ পরিবহনের দুই শতাধিক ট্রলি।

সিগন্যাল বাতি জ্বলে না, ‘ক্রিং ক্রিং’ শব্দই একমাত্র ভরসা
চিনি গোডাউনে কবুতরসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বাসা বানিয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোহা খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। পাখির বিষ্টায় ভরে গেছে কারখানার ভেতরের অংশ। দুর্গন্ধে সেখানে যাওয়া কষ্টসাধ্য। রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে মিলের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। পুরো এলাকায় ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে। মিল গেটের পাশে গড়ে ওঠা দোকানগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে। চা-স্টলের চুলাগুলো এখন পরিত্যক্ত। এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোও ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন।

মিলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নুরুল হোসেন বলেন, ‘কারখানাটা এখন এক প্রকার মৃত। আমাদের মৃত লাশ পাহারা দিতে হচ্ছে। অথচ তিনবছর আগেও এখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম থাকতো। গাড়িভর্তি আখ নিয়ে আসা হতো। ক্রেতা-ব্যবসায়ীদের আগমন ছিল। আশপাশে অনেক দোকানও ছিল। এখনই কিছুই নেই খালি জঙ্গল আর জঙ্গল। সন্ধ্যা হলেই ভুতুড়ে পরিবেশ। পাহারা দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। সব শ্রমিক-কর্মচারীরা পাশের জেলাগুলোর মিলে বদলি হয়ে গেছে। আমরা কয়জন আছি শুধু এই লাশ পাহারা দিতে। ভাবতেই কেমন যেন লাগে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, মিলের ভেতরে দিনরাত অলস বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। জনমানবহীন এলাকায় পাহারার কাজ করাও কষ্টকর। সামান্য কিছু টাকা বেতন পাই। আগে বেতন ঠিকমতো পাওয়া গেলেও গত ৪/৫ মাসে ঠিকমতো বেতন পাচ্ছি না। আমরা এখানে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছি। মিলটি চালু থাকলে একটা ব্যবস্থা হয়, কিন্তু বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছি।

বন্ধের পর থেকেই বিপাকে পড়েছেন মিলকে ঘিরে আখ চাষ করার চাষিরা। মিলটিকে ঘিরে পুরো জেলায় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার একর জমিতে আখ চাষ হতো, এইসব জমিতে এখন অন্য ফসল আবাদ করছেন চাষিরা। তারা জানান, আখচাষ লাভজন ছিল, অন্য কিছু আবাদ করে তারা সেভাবে লাভবান হচ্ছে না। আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে মিলে আখ সরবরাহ করতে না পারায় চাষিরা বিভিন্ন হাট-বাজারে আখ বিক্রি করছে। যার জন্য আগের তুলনায় দাম পাচ্ছে না।

পাবনা সদরের বলরামপুরের এলাকার আখচাষি আরিফুর রহমান নয়ন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পাবনা চিনিকলে আখ দিয়েছি। মিলটি বন্ধ হওয়াতে আখ নিয়ে বিপাকে পড়েছি। কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে বাধ্য হয়ে হাটে হাটে আখ পিস করে বিক্রি করতেছি। পাশের কোনো জেলার চিনিকলেও আখ সরবরাহ করতে পারছি না। পরিবহন খরচ বেশি হয়ে যায়।

পাবনা সুগার মিলের আখচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী দিলু বলেন, ‘পুরো জেলায় ৫-৬ হাজার একর জমিতে আখ চাষ হতে। সেসব জমিতে এখন অন্য ফসল আবাদ হচ্ছে। আখ একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং লাভজনক ফসল ছিল। মিলটি বন্ধ হওয়ায় জেলার প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কৃষকের ক্ষতি হয়েছে। আমি নিজেই ২৫-৩০ বিঘা জমিতে আখচাষ করতাম। এখন অন্য ফসল আবাদ করি। মিলটি চালু করলে এখনও রমরমা চলবে। প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। কারণ পাবনা অঞ্চল আখ চাষের অঞ্চল। প্রচুর আখ চাষাবাদ হয় এ জেলাতে। বিশেষ করে ঈশ্বরদীর প্রধান অর্থকরি ফসল আখকে বলে থাকি।

বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের মহাসচিব এবং পাবনা জেলা আখচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, আগে আখ চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছি। এখন চিনিকল বন্ধ হওয়াতে অন্য ফসল আবাদ করেও তেমন লাভের মুখ দেখছি না। আখ একটি লাভজনক ফসল। যেই জমিতে ৩০ বছর ধরে আখ চাষ করা হয়েছে সে জমিতে এখন শত চেষ্টা করেও অন্য ফসল ফলানো যাচ্ছে না। ফলে আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি। আমাদের অঞ্চলের হাজারো কৃষক সর্বশান্ত হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, চিনিকল বন্ধের সময় দেশের বাজারে ৬০ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি হলেও বর্তমানে বাজারমূল্য ১৩০-১৩৫ টাকা কেজি। মিলটি চালু করা হলে সরকার ও ভোক্তা লাভবান হবে।

পাবনা সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আখতারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই মুহূর্তে মিলটি চালু করার সরকারের তেমন উদ্যোগ নেই। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক পার্টনারশিপে চালুর ব্যাপারে চেষ্টা চলছে।

তিনি আরও বলেন, ‘বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পার্টনারশিপে মিলটি চালু করা যায় কি-না এমন একটি পরিকল্পনা চলছে। এমনটি হলে খুবই ভালো হবে। কারণ শুধু চিনি দিয়ে মিলটি চালু রাখা সম্ভব নয়। চিনির কাজ হয় মাত্র কয়েক মাস। বছরের বাকি সময় শ্রমিক-কর্মচারীদের তেমন কোনো কাজ থাকে না। এজন্য মিলকে লোকশান গুনতে হয়।

চুয়াডাঙ্গার চিনিকলের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এখানে শুধু চিনি না করে এর সাথে অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করতে হবে। যেমন কেরু চিনির পাশাপাশি মদ এবং অন্যান্য পণ্য উপজাত হিসেবে উৎপাদন করছে। এতে তাদের বছরে শতাধিক কোটি টাকা আয় হচ্ছে। আমাদেরও এমন কিছু চিন্তা নিতে হবে। তাহলে মিলটি চালু করা সম্ভব।’

সর্বশেষ - ঈশ্বরদী

আপনার জন্য নির্বাচিত
error: Content is protected !!