ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপ-২০২১ এর আওতায় এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক তৌহিদুর রহমানের নির্দেশনা ও সম্পাদনায় চার পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব প্রকাশ হলো আজ।
শরীফুল রুকন : একটি হিসাব দিয়ে শুরু করা যাক। গ্যাস্ট্রিক-আলসারের একটি বহুল প্রচলিত ওষুধের জেনেরিক নাম ওমিপ্রাজল। এর একটি কাঁচামালের নাম ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেট। এটি দিয়ে বেক্সিমকো ‘প্রোসেপটিন’, স্কয়ার ‘সেকলো’, অ্যারিস্টোফার্মা ‘ওমেপ’, ইবনে সিনা ‘প্রলোক’, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল ‘কোসেক’, ইনসেপ্টা ‘ওমেনিক্স’, নাভানা ‘ওমেটাক’, এসকেএফ ‘লোসেক্টিল’ ২০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল তৈরি করে।
২০১৯ সালের ২২ জুলাই ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একটি নথি থেকে জানা যায়, ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেটের দাম প্রতি কেজি ১২ ডলার বা প্রায় ১ হাজার টাকা। ১ কেজিতে হয় ১০ লাখ মিলিগ্রাম। তাহলে সরল হিসাব দাঁড়াচ্ছে, ১ কেজি কাঁচামাল দিয়ে ২০ মিলিগ্রাম ওমিপ্রাজল ক্যাপসুল তৈরি করা যাচ্ছে ৫০ হাজার পিস। আর খরচের হিসাব দাঁড়াচ্ছে, ১ হাজার টাকার কাঁচামাল দিয়ে ৫০ হাজার পিস ওষুধ তৈরি হলে একটি ওষুধে কাঁচামালের (সক্রিয় উপাদান) খরচ পড়ে ২ পয়সা। বাজার ঘুরে দেখা গেল, ওই নামিদামি ব্র্যান্ডগুলোর ওমিপ্রাজল ২০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুলের প্রতি পিসের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য গড়ে ৫ টাকা। ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট-ট্যাক্সেও ছাড় আছে। তাহলে কাঁচামালের খরচ ওষুধের দামের কত ভাগ পড়লো? অংক কষলে দাঁড়ায়- আড়াই শত ভাগের একভাগ মাত্র।
হিসাবটি তুলে ধরে মন্তব্য চাইলে একটি ওষুধ কোম্পানির কাঁচামাল আমদানির সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার অনুরোধ করে বললেন, হিসাব ঠিক আছে। তবে একটি ওষুধে দুই ধরনের কাঁচামাল থাকে- একটি সক্রিয় উপাদান, আরেকটি নিষ্ক্রিয়। সক্রিয় উপাদান হচ্ছে ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেট, ওষুধ বলতে এটাই বোঝায়; এটাই আসলে রোগ সারায়। আর নিস্ক্রিয় উপাদান হলো আটা-ময়দার মতো, যা দিয়ে ওষুধের আকার-আকৃতি দেওয়া হয়। আর ক্যাপসুলের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় উপাদান লাগে জিলেটিন, রেড আয়রন অক্সাইড, ইয়েলো আয়রন অক্সাইড ইত্যাদি নামের কিছু খাদ্যোপযোগী রাসায়নিক। একটি সূত্র জানায়, চিংড়ির খোসাও ক্যাপসুলের খোলস বানাতে ব্যবহার করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ওষুধের নিষ্ক্রিয় উপাদানের মধ্যে রয়েছে, স্টার্চ, ল্যাকটোজ, সুক্রোজ, চালের গুঁড়া, আটা-ময়দা টাইপের জিনিস। নিষ্ক্রিয় উপাদানের দাম পড়বে সক্রিয় উপাদানের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। এটা ধর্তব্যের মধ্যেই না। তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিগুলো যদি ১০ হাজার শতাংশ লাভ নেয়, আপনি কী করবেন? এটা বন্ধ করার উপায় কই?’
আরও মজার তথ্য হলো, ২০১৯ সালের ২২ জুলাইয়ের মাসখানের পরই বিশ্ববাজারে ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেট নামের কাঁচামালটির দাম ৪ ডলার কমে প্রতি কেজি ৮ ডলার হয়েছে বলে ওষুধ প্রশাসরেই নথি থেকে জানা গেছে। আর সেই দামে আনা কাঁচামাল দিয়ে বানানো একেকটা ওষুধে সক্রিয় কাঁচামালের পিছে খরচ পড়েছে দেড় পয়সারও কম!
তাহলে কি ২০১৯ সালের পরে ওমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধের দাম কোম্পানিগুলো কমিয়েছে? ঘুণাক্ষরেও না। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস তাদের ওমিপ্রাজল গ্রুপের সেকলো ২০ এমজি ক্যাপসুলের দাম প্রতি পিস ৬ টাকা বিক্রি করছে। আর অন্য কোম্পানিগুলোর দাম আগের মতোই প্রতি পিস ৫ টাকা আছে। উপরন্তু অসংখ্য ওষুধের দাম বৃদ্ধির খবর পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। চট্টগ্রামে ওষুধের পাইকারি বাজার হাজারি লেনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোনাস ১০ মিলিগ্রামের প্রতি বক্স (৩০ পিস ট্যাবলেট) ২০২০ সালে ৪১৫ টাকায় পাওয়া যেত; এখন এটি বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকায়। ইনসেপ্টার গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট প্যান্টনিক্স ২০ মিলিগ্রাম প্রতিটির দাম ২০২০ সালেও ছিল ৬ টাকা, এখন তা ৬.৭৫ টাকায়। একই কোম্পানির এসোনিক্স ২০ এমজির একটি ট্যাবলেটের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ছিল ২০২০ সালে পাঁচ টাকা, এখন ৬.৫০ টাকা। ড্রাগ ইন্টারন্যাশনালের প্রতিটি ডাইমেরল ৮০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ২০২০ সালে ছিল ৭ টাকা আর এখন ৮ টাকা। একই কোম্পানির ২০০ মিলিগ্রামের প্রতিটি ভোরিজল ট্যাবলেট ২০২০ সালে ছিল ১১০ টাকা, এখন তা ১২০ টাকা।
এভাবে ওষুধের দাম উত্তরোত্তর বাড়িয়েই চলেছে দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। অথচ বাড়ানোর কারণ হিসেবে সবসময় তারা আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দিয়ে থাকে। পত্রিকার পাতা খুললেই এর অনেক প্রমাণ মিলবে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রপ্তানিকারক দেশে কাঁচামালের দাম কমলেও আমাদের দেশে ওষুধের দাম কমানো হয় না। আর ওষুধের যে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে কোম্পানিগুলো, তার মাঝে কাঁচামালের খরচের অংশ যে একেবারেই নগণ্য, তা ওমিপ্রাজলের ঘটনাতেই স্পষ্ট।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সদস্য ও চট্টগ্রামভিত্তিক ওষুধ কোম্পানি এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত একুশে পত্রিকা বলেন, ‘কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির পরও ২০১৭ সালে একবার কিছু ওষুধের দাম কমেছিল। এরপর আর কোনো ওষুধের দাম কমেছে বলে আমার জানা নেই। কাঁচামাল, জ্বালানিসহ নানা খরচ বাড়ায় আমার প্রতিষ্ঠানের কোনো ওষুধের দাম গত তিন বছরে কমেনি।’
একই প্রশ্ন করলে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ও হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম শফিউজ্জামান কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘ওষুধের দাম কমেছিল, কিছু কিছু। তবে বাড়েনি।’ দাম কমেছে- এরকম ওষুধের নাম জানতে চাইলে শফিউজ্জামান বলেন, ‘এত কিছু মুখস্ত থাকে না। ওষুধ প্রশাসনে যোগাযোগ করুন। মূল্যটা দেখে তারা।’
গত তিন বছরে কোন কোন ওষুধের দাম বেড়েছে আর কোনগুলোর কমেছে- সে বিষয়ে একুশে পত্রিকাকে সুনিদিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও ওষুধ শিল্প সমিতি।
এই অনুসন্ধানের আগের ‘ওষুধের দামে আগুন ডাক্তারের উপহারে’ ও ‘জোচ্চুরি ফাঁস সরকারি ওষুধে’ দুটি প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, ওষুধ কোম্পানির বড় খরচটাই যায় বিপণনে, বিশেষ করে ডাক্তারদেরকে দেওয়া উপহার-উপঢৌকনে। আর সেই খরচটা কোম্পানিগুলো ওষুধের দামের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নির্মমভাবে লুটে নেয় অসহায় রোগীর পকেট থেকে। এই অমানবিক-অনৈতিক কৌশলের কথা গোপন করে কোম্পানিগুলো বরাবর অজুহাত দেয় কাঁচামালের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘অনুমান করছি, প্রথম যখন ওমিপ্রাজল বের হয়, সেই সময়ে দাম যেটা ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে এই ওষুধটির কাঁচামালের দাম কমেছে, কিন্তু এখানে মূল্য পুনরায় নির্ধারণ হয়নি। যদি বছরে দুইবার বসা যেত, আন্তর্জাতিক মূল্যগুলো নিয়ে, তখন মূল্য রিভিউ করতে গেলে এ ইস্যুগুলো সামনে আসতো। এমন হতে পারে, ওমিপ্রাজলের দাম একবার ঠিক করা হয়েছে, এটাকে আর রিভিউ করা হয় না। আছে তো আছেই। চলছে তো চলছে। কেউ আর গরজ করে না। এক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের অনেক কিছু করার আছে। কাঁচামালের দাম কমার যে তথ্য দিলেন সেটা সত্য হলে ওষুধের দাম অবশ্যই কমানো উচিত।’
কাঁচামাল নিয়ে আরও কিছু কারসাজির অভিযোগ রয়েছে অনেক ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে। দেশের বাজারের জন্য তারা ভারত ও চীন থেকে সস্তা দরের নিম্নমানের কাঁচামাল আমদানি করে। আর রপ্তানির ওষুধের জন্য আনে বেশি দাম দিয়ে উন্নত মানেরটা। আবার যে কাঁচামালের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে, সেটা আরও সস্তা দরে নিয়ে এসে ওষুধ বানিয়ে নতুন উৎপাদনের এবং দূরের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বসিয়ে বাজারে ছাড়ে অনেকে। ততদিনে হয়তো কাঁচামালের মেয়াদ যায় ফুরিয়ে। সেই ওষুধ খেয়ে রোগীর কী অবস্থা হয়, তার কোনো গবেষণা নেই দেশে। কাঁচামালের উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা দামের বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো তথ্য দেয় না। এই ফাঁকে মান নিয়ে চলে লুকোচুরি- দরকষাকষি এবং ওষুধের কাঁচামাল আমদানির আড়ালে অর্থপাচারের সুযোগও থেকে যায়।
সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখতে পাওয়া যায়, অধিদপ্তর থেকে ২ হাজার ৮০৪ ধরনের কাঁচামালের তালিকা দেয়া হয় ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। ২০২১ সালের জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষার গবেষণা নিবন্ধে ওষুধ প্রশাসনের বরাত দিয়ে বলা হয়, দেশে ওষুধ তৈরির কাঁচামালের মধ্যে ৬৭.৫ শতাংশ আমদানি করা হয় ভারত থেকে, এর পরেই যথাক্রমে চীন (১৮.৪ শতাংশ), জার্মানি (২.৮ শতাংশ) ও ইতালি (২.৬ শতাংশ)। কাঁচামালের অন্যান্য উৎস হলো তাইওয়ান, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, মালয়েশিয়া, জাপান, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ইত্যাদি (৮.৬ শতাংশ)।
কাঁচামাল বিক্রির মাধ্যম হিসেবে ফার্মাসোর্সেস ডটকম ও ওয়ার্ল্ড অব কেমিক্যালস ডটকমসহ বেশ কিছু ‘অনলাইন প্লাটফর্ম’ রয়েছে। শুধু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ক্রেতার যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এতে। এসব প্লাটফর্মে কাঁচামালের দাম উল্লেখ থাকে না। কোনো কোনো ওয়েবসাইটে কাঁচামালের দামের জায়গায় ‘আলোচনা সাপেক্ষে’ লেখা থাকতে দেখা গেছে। সুনির্দিষ্ট দাম উল্লেখ না থাকার কারণ জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মাসিউটিক্যাল এবং বায়োটেকনোলজি কোম্পানি ‘পিটিসি থেরাপিউটিকস’-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মুরাদ হোসেনের একটি লেখা থেকে। ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত ওই লেখায় তিনি প্রশ্ন করেন, “ভালো মানের এপিআই (ওষুধের কাঁচামাল) কি বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির দ্বারা সস্তা মূল্যে ভারত ও চীন থেকে আমদানি করা হয়? ভারত ও চীনের এই এপিআই প্রস্তুতকারকরা কি পশ্চিমা দেশগুলোর ওষুধ কোম্পানিগুলোতে একই দামে একই এপিআই রপ্তানি করছে? যদি তা না হয়, তাহলে তারা কীভাবে কম দামে বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছে এপিআই বিক্রি করে? তাহলে কী ওষুধ উৎপাদনে খরচ কম করার জন্য গুণগত দিকগুলির সাথে আপস করা হচ্ছে?’
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভারত ও চীনের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন মানের কাঁচামাল আলোচনা সাপেক্ষে বিভিন্ন দামে বিক্রি করে। পশ্চিমা দেশগুলোর ওষুধ কোম্পানিগুলো ভালো মানেরটা চায় বলে তাদেরকে দেওয়া কাঁচামালের দামও থাকে বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো সস্তায় কাঁচামাল আমদানি করতে চায়, মান যাই হোক না কেন। মূলত এ কারণেই ওষুধের কাঁচামালের দাম কখনও খোলাসা থাকে না। ক্রেতা-বিক্রেতা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দাম নির্ধারণ করেন।
কাঁচামাল আমদানি করতে গেলে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ‘ব্লকলিস্ট’ বানিয়ে অনুমোদন নিতে হয় ওষুধ প্রশাসন থেকে। ব্লকলিস্টে কাঁচামালের নাম, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, কী পরিমাণ আমদানি করা হবে, কত টাকা ব্যয় হবে, ওই কাঁচামাল দিয়ে কী কী ওষুধ বানানো হবে- ইত্যাদি তথ্য দিতে হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক সালমা সিদ্দিকা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কাঁচামাল আমদানির জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ব্লকলিস্ট অনুমোদন দেয়ার সময় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্লকলিস্টের সঙ্গে যাচাই করে দেখা হয়। সরকারি নীতি অনুযায়ী ওষুধের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে কাঁচামাল যত কম খরচে আমদানি করা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখেন কর্মকর্তারা। একই সময়ে একই কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ভেদে দামের তেমন পার্থক্য থাকে না। কারণ বেশিরভাগ কাঁচামাল আসে ভারত ও চীন থেকে।’
একুশে পত্রিকার সংগ্রহ করা ব্লকলিস্ট অনুযায়ী ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেটের ঘটনা আগেই বলা হয়েছে। আরেকটি কাঁচামাল- লেভোফ্লক্সাসিন হেমিহাইড্রেট দিয়ে লেভোফ্লক্সাসিন জেনেরিকের ওষুধ তৈরি করা হয়। এটা দিয়ে বেক্সিমকো ‘ইভো’ নামে, এসিআই ‘লেফলক্স’ নামে, একমি ‘লিও’, পপুলার ‘লেভোব্যাক’, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল ‘লেভোফ্লক্স’, রেনেটা ‘লেভোকিং’, এসকেএফ ‘লেভোম্যাক্স’, ইবনেসিনা ‘লেভোসিনা’, নাভানা ‘লেভোকুইন’ ব্র্যান্ডের ট্যাবলেট তৈরি করে। প্রতি ট্যাবলেটের দাম ব্র্যান্ড ভেদে ১৪ থেকে ১৬ টাকার মধ্যে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন। ব্লকলিস্ট ঘেঁটে দেখা যায়, এই কাঁচামাল একটি কোম্পানির আমদানির জন্য ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ওষুধ প্রশাসন অনুমোদিত মূল্য ছিল প্রতি কেজি ৫০ ডলার। একই বছরের ৪ আগস্ট সংশোধিত ব্লকলিস্ট অনুযায়ী ওই কাঁচামালের দাম কমে দাঁড়ায় ৩৩ ডলার। অথচ বাজারে ওই ওষুধের দাম একই আছে।
হোয়াইট সফট প্যারাফিন নামের কাঁচামাল দিয়ে স্টিবেট-সিএল, স্টেকলো, স্টিনাইড, স্টিসন ব্র্যান্ডের মলম তৈরি করে নাভানা। এটি আমদানির জন্য নাভানার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১৬ জুন ওষুধ প্রশাসন অনুমোদিত মূল্য হচ্ছে প্রতি কেজি ৫ ইউরো। একই বছরের ৪ আগস্ট ওই কোম্পানির আবেদনের প্রেক্ষিতেই সংশোধিত ব্লকলিস্ট অনুযায়ী ওই কাঁচামালের দাম কমে দাঁড়ায় ২.৭৫ ইউরোতে। এই কাঁচামাল দিয়ে ইমোলেন্ট ব্র্যান্ডের ক্রিম ও লোশন তৈরি করে স্কয়ার, ইনসেপ্টা বানায় ইমোসফট নামের মলম, ইবনেসিনা বানায় প্যারাফ্রেশ মলম। এসব মলমের দামও কমেনি।
২০১৯ সালের ২২ জুলাই ওষুধ প্রশাসন অনুমোদিত ইসোমিপ্রাজল সোডিয়াম কাঁচামালের দাম প্রতি কেজি ৮০০ ডলার। পরের মাসে ৪ আগস্ট উক্ত কাঁচামালের দাম কমে দাঁড়ায় ৩০০ ডলারে। কেজিতে ৫০০ ডলার কমলেও ২০১৯ সালের জুলাইয়ের পর এখন পর্যন্ত বাজারে ওই কাঁচামাল দিয়ে তৈরি ওষুধের দাম কমেনি।
২০২০ সালের ১৫ জুন ওষুধ প্রশাসন পাইরিডক্সিন এইচসিএল ও থায়ামিন মনোনাইট্রেট কাঁচামাল দুটি আমদানির জন্য মূল্য অনুমোদন দেয় প্রতি কেজি যথাক্রমে ৪০ ডলার ও ৫৫.৫০ ডলার। ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল ওষুধ প্রশাসনই আবার সংশোধিত ব্লকলিস্টে কাঁচামাল দুটির দাম কমিয়ে যথাক্রমে ২১ ও ২৭.৫০ ডলার অনুমোদন দেয়।
ওষুধ প্রশাসনে জমা পড়া সংশোধিত ব্লকলিস্ট অনুযায়ী আরও শতাধিক কাঁচামালের নাম পাওয়া গেছে, যেগুলোর দাম আগের চেয়ে বড় ব্যবধানে কমেছে। তবে কিছু কাঁচামালের দাম বিভিন্ন সময় বেড়েছে, যা সংশোধিত ব্লকলিস্ট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যদিও সময়ের ব্যবধানে সেই বর্ধিত দাম আবার কমেও গেছে।
ইসোমিপ্রাজল ম্যাগনেশিয়াম নামের কাঁচামাল দিয়ে এসোলোক ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি করে ইবনেসিনা, এসমেপ তৈরি করে এসিআই, এসোনিক্স বানায় ইনসেপ্টা, এসোটিড করে অপসোনিন ও এসোটাক বানায় নাভানা। বাজারে এসব কোম্পানির ওষুধের দাম ৫ থেকে ৭ টাকা। ২০২০ সালের ১৬ মার্চ ওষুধ প্রশাসনের ব্লকলিস্ট অনুযায়ী এই কাঁচামালের দাম প্রতি কেজি ৯০ ডলার।
এখানে লক্ষ্যণীয়, ইসোমিপ্রাজল ম্যাগনেশিয়াম ও ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেট কাঁচামাল দুটির মূল্যের ব্যবধান অনেক বেশি। কিন্তু এসব কাঁচামাল দিয়ে তৈরি ওষুধের মূল্যের পার্থক্যটা খুবই কম।
জানতে চাইলে জাতীয় ওষুধনীতি-২০১৬ প্রণয়ন উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমিও জানি না, কী কারণ। সেটা ওষুধ প্রশাসন বলতে পারবে। যে ওষুধের কাঁচামালের দাম বেশি, সেই ওষুধের দামও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে উল্টো হচ্ছে কেন, এটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। অনুমান করছি, প্রথম যখন ওমিপ্রাজল বের হয়, সেই সময়ে দাম যেটা ছিল, পরে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমেছে, কিন্তু এখানে মূল্য পুনর্নির্ধারণ হয়নি। এক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের অনেক কিছু করার আছে।’
জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা মো. আনোয়ারুল বাসেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কাঁচামালের দাম দেখে ওষুধের মূল্য সনদ দেয়া হয় বা দাম পুনরায় নির্ধারণ করা হয়। কম দামে কাঁচামাল এনে কোম্পানিগুলো বেশি দাম রাখছে কি না বিষয়টি আমার জানা নেই। কাগজপত্র যাচাই করে বলতে পারবো।’
দেশে আমদানি করা কাঁচামালের যে ৮৫.৯ শতাংশই ভারত ও চীন থেকে আনা হয়, তার গুণগত মান নিয়েও বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৯ সালের ১৪ নভেম্বর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, ‘ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচামালে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি এন-নিট্রোসডিমিথাইলামাইন (এনডিএমএ) পাওয়া গেছে; ফলে দেশে সব ধরনের রেনিটিডিন জাতীয় ওষুধের উৎপাদন, বিক্রি, বিতরণ ও রপ্তানি স্থগিত রাখতে হবে।’ এর আগে ২০১৮ সালে চীনের ঝেজিয়াং হুয়াহাই, ঝুয়াই রুন্ডু ও ঝেজিয়াং তিয়ানয়ু ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের তৈরি এপিআই ভালসারটানে এন-নাইট্রোসোডাইমেথালেমিন (এনডিএমএ) শনাক্ত হয়। ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকেই দেশের বেশির ভাগ ওষুধ কোম্পানি কাঁচামাল আমদানি করে।
ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের কাঁচামাল আমদানির অভিযোগের বিষয়ে এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকতের যুক্তি হলো- ‘আমরা যে এন্টিবায়োটিক সেবন করি, সেগুলোর কাঁচামাল চায়না ছাড়া আমদানি করার সুযোগ নাই। হার্টের ওষুধ, ডায়বেটিসের ওষুধের কাঁচামাল ভারত ছাড়া অন্য দেশ উৎপাদন করে না। ধরা যাক, ভারতের কাঁচামালের কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা মাসে ১০০ টন। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার মার্কেটে তো এত বড় বাজার নাই। তারা হয়তো ২০ টন নেবে, তাই দামও বেশি রাখা হবে। আর বাকি ৮০ টন এশিয়ার মার্কেটগুলোতে সস্তায় দিতে হবে।’
এদিকে সরকারিভাবে দেশেই ওষুধের কাঁচামাল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলেও রহস্যজনক কারণে সেটিতে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ায় নির্মিত এপিআই পার্কে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির কারখানা স্থাপনে খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না ওষুধ কোম্পানিগুলোর। এর কারণ হিসেবে অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এবং অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ- দুজন বিশেষজ্ঞই বলেন, দেশের মাটিতে হলে তো ওদের সব কারসাজি ফাঁস হয়ে যাবে! তাছাড়া ওষুধের চেয়ে কাঁচামাল উৎপাদনে তুলনামূলক লাভ কম। আরেকটি কারণ হতে পারে, কাঁচামাল আমদানির নামে বিদেশে অর্থপাচারের যে সুযোগ থাকে, তা বন্ধ হয়ে যাওয়া। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কোম্পানির কাঁচামাল আমদানির সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিগুলো যা লাভ দেখায়, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি লাভ করে তারা। যে কাঁচামালের দাম ১০ ডলার, তা ৫০ ডলারে কিনেছে বলে দেখানো সম্ভব। এক টন এনে দুই টনের খরচ দেখানো যায়। এভাবে বিদেশে টাকা পাচারের সুযোগ আছে। এ কারণেই হয়তো দেশে কাঁচামাল তৈরির দিকে তারা ঝুঁকছে না।’
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক আরও বলেন, ‘কিছু কোম্পানি টাকা বাঁচাতে কম মেয়াদ থাকা কাঁচামাল আমদানি করে। তিন বছর মেয়াদ আছে আর এক বছর মেয়াদ আছে- এমন কাঁচামালের মূল্য এক নয়। কমপক্ষে তিন বছর মেয়াদ থাকা প্রয়োজন ওষুধের কাঁচামালের। কিন্তু অনেক সময় কম মেয়াদের কাঁচামাল এনে ওষুধ বানিয়ে কোম্পানিগুলো ওষুধের গায়ে নতুন মেয়াদ উল্লেখ করছে ৩ বছর, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও বিপজ্জনক। কিন্তু ওষুধ কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্ট জায়গায় টাকা ঢেলে দেয়; ফলে সব মানসম্পন্ন হয়ে যায়!’
কাঁচামালের দাম কমার পরও ওষুধের দাম না কমানো প্রসঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সংশোধিত ব্লকলিস্টে অনেক সময় দেখা যায় কাঁচামালের দাম অনেক কমে গেছে। ১০ টাকার কাঁচামাল দুই টাকায় কেনে তারা। তখন ওষুধের দাম কমানোর জন্য তাগিদ দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। তখনও আমরা সহজে ওষুধের দাম বাড়াতে দিই না। যদি অনেক দিন ধরে দাম বেশি থাকে, তখন বাড়ানোর চেষ্টা করে তারা। যৌক্তিক হলে মূল্যটা তখন বাড়িয়ে দিতে আমরা বাধ্য হই।’
ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের কাঁচামাল আমদানির অভিযোগ প্রসঙ্গে অধিদপ্তরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘নিম্নমানের কাঁচামাল যদি কেউ আনে, তার পণ্যও নিম্নমানের হবে। এ রকম কিছু যদি আমরা ধরতে পারি, তখন পণ্য এবং লাইসেন্স বাতিল করে দিই। ওষুধ বাজারে গেলে যে কেউ অভিযোগ করতে পারেন। তখন আমরা ওষুধটি পরীক্ষা করে দেখি। তারপরও বলি, নিম্নমানের কাঁচামাল আনা হতে পারে, দেশে চোরের তো অভাব নাই। এ রকম যে হয় না, শতভাগ নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারবো না, যেহেতু আমাদের লোকবল কম।’
২০২১ সালের মে মাসে প্রকাশিত ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৯-২০’-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘২০১৯-২০ অর্থবছরে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে মাত্র ৩ হাজার ৩৯৭টি ওষুধের মান পরীক্ষা সম্ভব হয়েছে।’ অথচ দেশে বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় ৩২ হাজার ওষুধ তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘সব ওষুধ পরীক্ষা করার সুযোগ থাকে না। তবে সারা দেশ থেকে আমরা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করি। অনিয়ম ধরা পড়লে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়।
সূত্র. একুশে পত্রিকা/ শেখ মেহেদী হাসান
আরও পড়ুন :