দেশভাগের পর উত্তর ভারতের কয়েকটি অঞ্চল থেকে কয়েকজন বেনারসি কারিগর পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় বসতির পর সেখানে তারা বেনারসি-কাতানসহ বেশ কয়েক ধরনের অভিজাত শাড়ি বোনার কাজ শুরু করেন। সে সব পুরনো কারিগরদের সবাই মারা গেছেন। তাদের উত্তরসূরিরা এ অঞ্চলে এখনো ঐতিহ্যবাহী বেনারসি শাড়ি বোনার কাজ করছেন। এ অঞ্চলে এখনো প্রায় ২ শতাধিক বেনারসি কারিগর পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে বেনারসি-কাতান বুনে চলছেন।
বর্তমানে বাজারে নানান বিদেশি পণ্যের উপস্থিতিতে বেনারসি-কাতানের বিক্রি কমলেও অভিজাত সমাজে এখনো এর কদর আছে। শাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ায় সঙ্কটে পড়েছেন দেশের অন্যতম বৃহত্তম বেনারসি পল্লীর কারিগররা। হাতের কাজের এ শিল্পকে প্রসারিত করতে ২০০৪ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ফতেহ মোহাম্মদপুরে সাড়ে ৫ একর জায়গায় গড়ে তোলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেনারসি পল্লী।
এ অঞ্চলের কারিগরদের কম দামে প্লট বরাদ্দ দিয়ে বেনারসি কারখানা স্থাপন ও সেখান থেকে উৎপাদিত পণ্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বিপণনের সুব্যবস্থার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় বেনারসি পল্লী গড়ে তোলা হয়। কারিগরদের জন্য সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিতের কথা ছিল এ পল্লীতে। ২০ বছর মেয়াদি প্রকল্পের ১৮ বছর কেটে গেলেও কোনো উদ্যোগই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়নি। প্লট নিয়ে কারখানা গড়ে তুলতে পারেনি বেশিরভাগ তাঁতি।
ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ৯০ প্লট বরাদ্দ দেয়া
হয়েছে। এর মধ্যে ৭০টি ৩ শতাংশের ও ২০টি ৫ শতাংশের প্লট।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে প্রকল্পের জমি বরাদ্দ দেয়া হলেও বেশিরভাগ প্লট ব্যবহৃত না হওয়ায় পুরো পল্লী এখন আগাছায় পূর্ণ। প্রকল্প এলাকায় মসজিদ ছাড়া অন্যান্য স্থাপনাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে।
বেনারসি পল্লীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওবাইদুর রহমান জিলানি বলেন, কারিগররা কম দামে প্লট নিলেও তাদের অনেকেই কারখানা করেননি। অনেকে আবার নিয়মনীতি না মেনে বরাদ্দ পাওয়া প্লট অন্যদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। বরাদ্দ নেয়া ৯০ প্লটের মধ্যে মাত্র ১৫ প্লটের কিস্তি নিয়মিত দেয়া আছে, উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাকিদের অনেকে কিস্তির টাকা এখনো পরিশোধ করেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৯০ প্লটের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭টিতে কারখানা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগ বছরের পর বছর ধরে বন্ধ। কয়েকটি কারখানা চালু থাকলেও সেগুলো চলছে বাইরের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে। স্থানীয় কারিগরদের অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
ওবাইদুর রহমান জিলানি বলেন, ২০ বছর মেয়াদী প্রকল্পে ১৮ বছরেও কারখানা স্থাপন না করায় ও দীর্ঘদিন প্লটের টাকা পরিশোধ না করায় গত মার্চে তাঁত বোর্ড ৯০ প্লট গ্রহীতার মধ্যে ৮৫ জনকে নোটিশ দেয়।
এতে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা পরিশোধ না করলে বরাদ্দ বাতিল করা হবে। ইতিমধ্যে একজনের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। বেনারসি প্রকল্পের কার্যালয়ের অবস্থাও করুণ। লোকবলের অভাবে এটি নিয়মিত খোলা হয় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একজনকে নিয়োগ দেয়া হলেও তাকে নিয়মিত অফিসে পাওয়া যায় না। ওয়েবসাইটে তার মোবাইল নম্বর দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
ওবাইদুর রহমান জিলানি বলেন, অফিস খোলা হয়, তবে লোকবল না থাকায় সার্বক্ষণিক খোলা রাখা সম্ভব হয় না। তাঁতিদের ঋণ দেয়া ও কিস্তি নেয়ার কাজ চলে। তাঁতিরা জানান, প্লট বরাদ্দ নিলেও কারখানা করে ব্যবসা করার মতো পুঁজি তাদের নেই।
ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর ঐতিহ্য বহন করে চলা কারিগর জাবেদ বেনারসি লন, ১৯৪৭ সালের পর ভারত থেকে বাবা আব্দুল মজিদসহ বেশ কয়েকজন বেনারসি কারিগর ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় বসতি গড়েন।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। রঙ ও সুতাসহ কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি ভারতীয় শাড়ির প্রভাবে বাজারে বেনারসি-কাতান বিক্রি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে বলে জানান তিনি। হাতে চালানো তাঁত দিয়ে বেনারসি-কাতান বুননে শ্রমিকের খরচ অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি শাড়ি তৈরিতে ৩ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি দিতে হয়। ১২ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা দামের শাড়ি এখানে তৈরি করা হয়। স্থানীয় বাজারে এর ক্রেতা পাওয়া কঠিন।
ব্যবসায়ী জাবেদ বলেন, পুঁজির অভাবে অনেকেই ইতিমধ্যে পেশা পরিবর্তন করেছেন। এ অবস্থায় বেনারসি পল্লীতে নতুন করে বিনিয়োগের অবস্থা কোনো তাঁতিরই নেই। স্থানীয় তাঁতিরা কারখানা করে ব্যবসা করতে না পারলেও অন্য অঞ্চলের বড় বড় ব্যবসায়ীরা কয়েকটি কারখানা করেছেন। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার বৃহত্তম কাপড়ের কারখানা জামান টেক্সটাইল ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীতে ২টি কারখানা চালু রেখেছে।
কারখানার ম্যানেজার শরিফুল আলম বলেন, অবাঙালি তাঁতিদের নামে বরাদ্দ দেয়া প্লটে কারখানা করে ব্যবসা করতে হচ্ছে। কারখানা ২টিতে প্রায় ৩০ তাঁত চালু আছে। প্রতি সপ্তাহে ২৫-২৬ শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো আড়ংয়ে সরবরাহ করা হয়। তবে, এখানে কারখানা করলেও কোনো সুবিধা মিলছে না বলে জানান তিনি।
শরিফুল আলম বলেন, এখানে প্রসেসিং কারখানা করার কথা থাকলেও তা হয়নি। ঢাকা থেকে সুতা প্রসেস করে আনতে হয়। প্রতি শাড়িতে প্রায় ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেশি খরচ হয়। এখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। কারখানা চলানো ঝুঁকিপূর্ণ। পুঁজি বিনিয়োগ করায় ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসা করতে হচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
পল্লীর কর্মকর্তা ওবাইদুর রহমান জিলানি বলেন, প্রকল্প এলাকার বেশিরভাগ কারখানা স্থাপন না হওয়ায় এখানে সব ধরনের সুবিধা এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।