পাবনার ঈশ্বরদীতে নিঃসন্তান নারীদের তান্ত্রিক চিকিৎসার মাধ্যমে গর্ভে সন্তান ধারণ ও জ্বীনের দেওয়া সোনার মোহরে কোটিপতি হওয়ার আশ্বাস দিয়ে অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ভন্ড কবিরাজ দম্পতি।
এ ঘটনায় কবিরাজ দম্পতির স্বামী মো. মেহেদী হাসানকে আটক করেছে পুলিশ।
পৌর শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের অরোনকোলা এলাকার মেহেদী ও আয়েশা খাতুন মৃত্তিকা নামে এই দম্পত্তি দীর্ঘদিন ধরে কবিরাজী চিকিৎসার নামে প্রতারণার জাল বিস্তার করে চালিয়ে আসছিলো তাদের এ প্রতারণা।
কথার ফুলঝুড়ি আর ঝাড়ফুঁকের ভেল্কিবাজিতে কোটিপতি হওয়ার আশায় লাখ লাখ টাকা খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। আটককৃত মেহেদী হাসান ঐ এলাকার আবু বক্করের ছেলে।
জানা গেছে, ছোটবেলা থেকেই মৃত্তিকা নামের এই নারীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল জ্বীনের। তারই সূত্র ধরে স্থানীয় পর্যায়ে তারা শুরু করেন কবিরাজি চিকিৎসা। এতে ধীরে ধীরে লোকমুখের প্রচারণায় ব্যাপক পরিচিত হয়ে ওঠেন এই দম্পত্তি। সেই সঙ্গে বাড়াতে থাকেন নিঃসন্তান নারীদের গর্ভে সন্তান লাভ ও জ্বীনের দেওয়া সোনার মোহরে কোটিপতি হওয়াসহ নানা প্রতারণার ছক।
জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে বন্ধাত্বমূলক সমস্যা সমাধান, জ্বীনের আছর ছাড়ানো ও ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসা নিতে আসা সহজ সরল মানুষদের কাছে তারা বলতেন আমাদের মাধ্যমে জ্বীন বাবাজীর দোয়া ও ওষুধ খেলেই দুই মাসের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা নারীর গর্ভে সন্তান আসবে।
এছাড়াও জ্বীনের দেওয়া কয়েকটি সোনার মোহর মাটির হাড়িতে করে ১৫ দিন ঘরে রাখার পর তাদের কাছে নিয়ে এসে একেকটি মোহর ভাঙলে চার লাখ টাকা করে পাওয়া যাবে। তবে শর্ত একটাই মাটির হাড়ি ও মোহরের কথা কাউকে বলা যাবে না। বললে পরিবারের ক্ষতি হবে। আর এসব কিছুর বিনিময় হিসেবে দাবি করতেন এক থেকে দেড় লাখ টাকা। এভাবেই এই ভন্ড কবিরাজের কাছে প্রতারণার শিকার হয়ে ধার দেনা করে এনে দেওয়া টাকা ফেরত চাইতে কয়েকজন ভুক্তভোগী উপস্থিত হয় সেই ভন্ড কবিরাজের বাড়িতে। আর সেখানেই বাঁধে বিপত্তি।
টাকা ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা বরং ভুক্তভোগীদের নানা হুমকি ধামকি ও হয়রানি শুরু করলে ভুক্তভোগীরা জরুরি সেবা ৯৯৯ কল দিলে ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে প্রতারক দম্পতির স্বামী মেহেদী হাসানকে আটক করে। এদিকে পুলিশের উপস্থিতির আগেই স্ত্রী আয়েশা খাতুন মৃত্তিকা পালিয়ে যায়।
লালপুর উপজেলার বাসিন্দা ভুক্তভোগী বীনা বেগম বলেন, আত্মীয়তার সম্পর্কের খাতিরে জানতে পারি তারা জ্বীন হাজিরের মাধ্যমে নানারকম চিকিৎসা করেন। তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসলে মাটির হাড়িতে জ্বীনের দেওয়া সোনার মোহর ১৫ দিন ঘরে রাখলে সেখান থেকে ২০ লাখ টাকা পাওয়া যাবে বলে জানায়। এর বিনিময়ে তারা আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করেন। সরল মনে অনেক কষ্টে জোগাড় করে ৮০ হাজার টাকা দেওয়ার পর থেকেই তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে সেই মাটির হাড়ি ভেঙে দেখি বাচ্চাদের চকলেট রয়েছে। দিশেহারা হয়ে তাদের কাছে টাকা ফেরত চাইলে তারা নানা তালবাহানা শুরু করে। এমন অনেক মানুষের সঙ্গে তারা প্রতারণা করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
ঈশ্বরদী উপজেলা সিলিমপুর গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, আমার স্ত্রী নিঃসন্তান হওয়ায় লোকমুখে শুনেছি এই কবিরাজের কাছে আসলে নাকি অন্তঃসত্ত্বা হওয়া যায়। তাই তাদের কাছে আমার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলাম। তারা নানারকম ঝাড়ফুঁক আর জ্বীনের দেওয়া কিছু ওষুধ হাতে দিয়ে সেগুলো খেতে বলেন। ওষুধ খাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা পেটে আসবে বলে ফি হিসেবে ২০ হাজার টাকা নেন আমাদের কাছ থেকে। এভাবে কয়েক দফায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তাদের দেওয়া ওষুধ খেয়ে আমার স্ত্রী এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের রিমপা খাতুন জানান, তাদের দেওয়া ওষুধ সেবন করার এক মাসের মধ্যে পেট ফুলে গিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ভাব অনুভব করি। তারপর তাদের কাছে আসলে ভুয়া প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছি বলে সুখবর দেন। এভাবে কয়েক দফায় তারা ৮৫ হাজার টাকা নিয়েছে আমার কাছ থেকে।
কবিরাজি চিকিৎসার নামে এভাবে প্রতারণার ফাঁদ প্রকাশ হওয়ার পর স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসীও ক্ষোভ প্রকাশ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন এই প্রতারক চক্রের।
ঈশ্বরদী থানার ওসি মো. শহীদুল ইসলাম শহিদ জানান, ৯৯৯ ফোন আসার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে একজনকে আটক করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরা এখনো কোনো মামলা দায়ের করেননি। আটককৃত আসামিকে আদালনে প্রেরণ করা হবে।
ভিডিও: