পাবনার ঈশ্বরদীতে কলাগাছে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে পানামা রোগ। কয়েকশ হেক্টর জমির গাছ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কৃষকদের চোখের সামনেই মরছে হাজার হাজার কলাগাছ। ফলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাঁদছেন চাষিরা।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার পদ্মার চর জুড়ে ১৮৪০ হেক্টর জমিতে কলার চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নেই ১৮০০ হেক্টর জমিতে কলা আবাদ হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কলাচাষে লাভবান হওয়ায় ইউনিয়নের কামালপুর, দাদাপুর, লক্ষ্মীকুণ্ডা, কৈকুণ্ডা, চরকুড়ুলিয়া, শান্তিনগর, ডিগ্রীর চর জুড়ে কৃষকরা অন্য ফসল না করে এবার শুধু কলার আবাদ করেছেন।
স্থানীয় কলাচাষিরা জানান, একটি অজ্ঞাত ভাইরাস কলা গাছে আক্রমণ করেছে। এ ভাইরাস প্রথমে কলাগাছের পুরাতন পাতাতে আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে উপরের দিকে পৌঁছে কচি পাতাকেও আক্রমণ করে। এতে কলাপাতা বাদামী বর্ণ ধারণ করে শুকিয়ে যায়। কিছুদিন পর পাতা ঝরে পড়ে। ভাইরাসের আক্রমণে কলাগাছের গোঁড়া বা কাণ্ড হলদেটে থেকে লালচে আঁকাবাঁকা দাগ হয়। পরে গোঁড়ার নিচ ও ওপরের অংশে পচন ধরে গাছের মৃত্যু হয়। অনেক সময় কলা গাছ ফেটে যায়। গাছ কাটার পর ভেতরের সাদা অংশ কালচে দেখা যায়। এ বছর হাজার হাজার কলা গাছ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। এ ছাড়াও এ ভাইরাসে আক্রান্ত কলার ওপরের অংশে কালচে দাগ হয়। কলা অপোক্ত ও স্বাদহীন হয়। এ রোগ থেকে কলা গাছকে রক্ষা করা না গেলে শত শত চাষি বাধ্য হয়ে লোকসান থেকে বাঁচতে কলা চাষ বন্ধ করে দিবে।
জানা গেছে, ৫-৬ বছর আগে উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চল জুড়ে শুরু হয় কলা চাষ। প্রথম বছরেই চাষিরা ব্যাপক লাভবান হওয়ায় পর্যায়ক্রমে এ ইউনিয়নের ১৮০০ হেক্টর জমিতে কলা চাষাবাদ করা হয়। এ ছাড়াও উপজেলার অন্যান্য এলাকায় আরও ৪০ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়। চরাঞ্চলে কলাচাষ বদলে দিয়েছে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি। চাষিরা সবাই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
প্রতি বিঘা জমিতে ৩৫০ থেকে ৪০০ কলার চারা রোপণ করা হয়। জমির খাজনা, সার-বীজ ও চাষাবাদ খরচে গাছপ্রতি খরচ হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এখানকার প্রতিটি কলার ছড়ি বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা পর্যন্ত। প্রতি বিঘায় কৃষকের কমপক্ষে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভ হয়। এখানে সবচেয়ে চাষ হয় সরবি কলা। এ ছাড়াও মেহেরসাগর, অমৃতসাগর ও মন্দিরা কলার চাষ হয়।
স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানায়, রোগাক্রান্ত কলা গাছ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পানামা রোগ মুক্ত চারা সংগ্রহ করে রোপণ করতে হবে। দুই তিন বছর পর কলা চাষ বন্ধ রেখে ওই জমিতে অন্য ফসল ফলাতে হবে। এছাড়াও জমিতে চুন প্রয়োগ করে মাটির জৈব শক্তি বাড়ালে পানামা রোগ থেকে কলা গাছ মুক্ত রাখা যেতে পারে।
চরকুড়লিয়া গ্রামের কলাচাষি সাখাওয়াত মণ্ডল বলেন, তিন বিঘা জমিতে আমি কলাচাষ করেছি। এবার প্রতিটি কলা গাছ ভাইরাসের আক্রমণে মরে যাচ্ছে। খুব যত্নে লাগানো কলা গাছ চোখের সামনে মরে যাওয়া দেখে খুব কষ্ট লাগছে।
পাবনা সদর চরপ্রতাপপুর গ্রামের চাষি আব্দুল হালিম ঈশ্বরদীর লক্ষ্মীকুণ্ডার শান্তিনগর চরে ১২০ বিঘা জমিতে কলার চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ১১ বছর ধরে আমি কলার আবাদ করছি। শান্তিনগর চরেও পাঁচ বছর ধরে আবাদ করছি। প্রতি বছরই কলা চাষে লাভ হয়। এবার ভাইরাসের কারণে কলা গাছ মরে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়াও সার-কীটনাশকের দাম বৃদ্ধির কারণে লোকসানের পরিমাণ আরও বেড়েছে।
চরকুড়ুলিয়া গ্রামের স্কুল শিক্ষক ও কলাচাষি সেলিম রেজা বলেন, উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডার ডিগ্রীচর ও শান্তিনগর এলাকাজুড়ে শত শত হেক্টর জমিতে পাঁচ বছর ধরে কলার আবাদ হচ্ছে। ২০২৩ সাল থেকে কলা বাগানে ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়। এবার শতকরা ৭০ ভাগ কলা বাগানে ভাইরাস আক্রমণ করেছে। ভাইরাসের আক্রমণ থেকে কৃষকদের বাঁচানোর জন্য উপজেলা কৃষি অফিস সরেজমিনে কলা বাগানে এসে ভাইরাস প্রতিকারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দিলে তারা ব্যাপক লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতো।
লক্ষীকুণ্ডা ইউনিয়নের কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তা শামীমা খাতুন বলেন, ভাইরাসের আক্রান্ত কলা গাছের পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলা ও ছত্রাক নাশক স্প্রে করার পরামর্শ দিয়েছি।
স্থানীয় কৃষি অফিস কৃষকদের এ ভাইরাস সম্পর্কে কোনো পরামর্শ দেয়নি এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিটি কলাচাষির দ্বারে দ্বারে গিয়ে পরামর্শ দেওয়া সম্ভব নয়। যারা পরামর্শ চেয়েছেন তাদের দেওয়া হয়েছে
উপজেলা কৃষি অফিসার মিতা সরকার বলেন, পানামা রোগে আক্রান্ত কলা গাছ উপড়ে ফেলতে হবে। সবসময় চেষ্টা করতে হবে ভাইরাসমুক্ত কলা চারা লাগানো, তাহলে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।