রেলের শহর বলে খ্যাত পাকশীর আছে স্বকীয়তা। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার মাত্র ৭ দশমিক ৩৮ বর্গমাইল আয়তনের এই ইউনিয়ন গ্রামীণ সৌন্দর্যে ভরপুর। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। পাকশী এবং এর আশপাশের এলাকা ঘুরে লিখেছেন আবু দারদা মাহফুজ
গত বছরের অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ। সরাসরি বাসেই পাকশী যেতে পারতাম, কিন্তু যাত্রাটা আরও উপভোগ্য করতে বেছে নিলাম ট্রেন। সকাল আটটায় ট্রেন ছাড়বে। ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর রেলস্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম বেশ কিছুটা সময় হাতে রেখেই। এখান থেকেই আমার যাত্রা শুরু হবে। ট্রেন একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে স্টেশনে এসে পৌঁছাল। যাত্রায় সঙ্গী হলো আমার ব্যাকপ্যাক, ক্যামেরা, মুঠোফোন আর অল্প কিছু টাকা। শীত শীত সকালে কুয়াশার মিহি চাদর ভেদ করে ট্রেন আমাকে নিয়ে ছুটে চলল গন্তব্যের দিকে। প্রায় আড়াই ঘণ্টার যাত্রা শেষে ট্রেন পৌঁছাল পাকশী স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। তখন সকাল সাড়ে ১০টা।
শীত শীত সকালে পাকশী স্টেশন
পাকশী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মটি সমতল থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। ওই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে শুরুতে চোখ গেল দক্ষিণ দিকে খানিকটা দূরের চারটি বৃহদাকায় স্থাপনার দিকে। ওসব আদতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চারটি চুল্লি। এরপর প্ল্যাটফর্মের পশ্চিম দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল লোহার লাল রঙের রেলসেতুটি। এটি মূলত শতবর্ষী হার্ডিঞ্জ রেলসেতু। প্ল্যাটফর্ম থেকে একটি সিঁড়ি নেমে গেছে ঠিক নিচের স্টেশন প্রাঙ্গণে। সেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে পা রাখলাম সেখানে। স্টেশন লাগোয়া একটি মুদিদোকান থেকে কিছু হালকা খাবার ও পানি কিনলাম। হাঁটতে শুরু করলাম পশ্চিম দিকের ঢালু পথ বরাবর।
পদ্মা নদী, রেলসেতু আর লালন শাহ সেতু
হার্ডিঞ্জ রেলসেতুর নিচের পদ্মা নদীর পাড়ে গেলাম হেঁটে হেঁটে। নদীর পাড়ে সারবাঁধা নৌকা। ওপর দিয়ে চলে গেছে লাল রঙের রেলসেতু। সেখানে দাঁড়িয়েই স্পষ্ট দেখলাম, কিছুটা দূরে রেলসেতুর সমান্তরালে এপার থেকে ওপারে যাওয়া আরেকটি সড়ক সেতু। এটি লালন শাহ সেতু। নদীর পাড়ে বিরাট অংশ জুড়ে আছে বালু বিক্রয়কেন্দ্র। পাকশীর বালু দেশজুড়ে খ্যাত।
নদীর এপারে দাঁড়িয়ে ওপারে আবছা দেখা যায়। ঘন সবুজে ঘেরা ওপারটা ভৌগোলিকভাবে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলায় পড়েছে। নদীতে স্রোত ছিল বেশ। বেঁধে রাখা নৌকাগুলো তাই স্রোতের তোড়ে একটি–অপরটির সঙ্গে টক্কর খাচ্ছিল।
রেলওয়ের বিভাগীয় দপ্তর, বাষ্পচালিত ট্রেনের লোকোমোটিভ
নদীর পাড় থেকে হেঁটে হেঁটে চলে এলাম কাছের রূপপুর রেলস্টেশনের কাছে। নবনির্মিত এই স্টেশন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হবে। সেখান থেকে ইজিবাইক ভাড়া করলাম সারা দিনের জন্য। ইজিবাইকে করে পৌঁছালাম রেলওয়ের বিভাগীয় সদর দপ্তরে। ইজিবাইক থেকে নেমে ঢুকলাম বিভাগীয় ব্যাবস্থাপকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে। প্রাঙ্গণটি বেশ সাজানো–গোছানো। মেঝে বাঁধানো, কোথাও কোথাও আলপনা আঁকা। রেলওয়ের একটি পুরোনো ন্যারোগেজ বাষ্পীয় ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) প্রদর্শনীর জন্য রাখা আছে। বাষ্পীয় ইঞ্জিনটির পাশেই একটি বোমার অংশবিশেষ চোখে পড়ল। বোমাটি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হার্ডিঞ্জ রেলসেতুর ওপর নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
পুরো কার্যালয় এলাকাটি উঁচু উঁচু গাছে ঢাকা। কার্যালয়ের ভেতরে লাল ইটের পুরোনো ধাঁচের বিভিন্ন ভবন আছে ছড়িয়ে– ছিটিয়ে। ভবনগুলোর স্থাপত্যশৈলী আলাদাভাবে নজর কাড়ে। কিছুটা দূরে দেখতে পেলাম, রেলওয়ের বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ। এই কক্ষ থেকে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের বেশির ভাগ ট্রেনের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ন্ত্রণকক্ষের ঠিক পাশেই পুলিশ সুপারের কার্যালয়।
এরপর পা বাড়ালাম অফিসার্স কোয়ার্টারগুলোর দিকে। প্রাচীরঘেরা এই অংশের মধ্যে হার্ডিঞ্জ রেলসেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী গেইল সাহেবের বাংলো আছে বলে শুনেছি। কিন্তু শুরুতেই নিরাপত্তারক্ষী আমাকে আটকে দিল। ‘ওপরের’ অনুমতি ছাড়া সেখানে প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ। আমার কাছে ওপরের কোনো অনুমতি ছিল না। অগত্যা সেখান থেকে প্রস্থান। আবার ইজিবাইকে চড়ে বসলাম। এবার যাত্রা গার্ড ব্যাংকের দিকে।
গার্ড ব্যাংক আর বটবৃক্ষের প্রশান্তির ছায়া
গার্ড ব্যাংক মূলত নদীর তীর ঘেঁষে বেড়ে ওঠা একটি ছোট্ট পাড়া। রেলওয়ে অফিসের একেবারে কাছেই। নদীর পাড়েই সেখানে দুটি বড় বটবৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। শরতের রোদে ক্লান্ত শরীর। বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিলাম। গার্ড ব্যাংকের প্রশান্তি গায়ে মেখে এবার অন্য গন্তব্যের দিকে রওনা হওয়ার পালা। গার্ড ব্যাংক থেকে দক্ষিণ দিকে তাকালে দূরের হার্ডিঞ্জ রেলসেতু দেখা যায়।
সাঁড়া ঘাট
গার্ড ব্যাংক থেকে কয়েক মাইল দূরের সাঁড়া ঘাট অবশ্য পাকশী ইউনিয়নের ভেতরে নয়। এটি সাঁড়া নামের আরেকটি ইউনিয়নভুক্ত। এই ঘাটের কাছে এসে পদ্মা নদী বাঁক নিয়েছে অনেকটা। নদীর পানিতে শরতের আকাশের পুরো প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। নদীর বুকে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল কয়েকটি নৌকা। নদীর পাড়ে বাতাসের তেজ ছিল বেশ। সাঁড়া ঘাটে এসে ক্লান্তি যেন এক নিমেষেই দূর হয়ে গেল। প্রকৃতি এখানে অপূর্ব। দেখতে দেখতে মাঝদুপুর। দুপুরের খাবার খেতে রওনা হলাম রূপপুর বাজারের দিকে।
বিখ্যাত সাঁকো
রূপপুর বাজারে ঢোকার ঠিক আগে পার হতে হলো পাকশীর বিখ্যাত এক সাঁকো। উঁচু রেললাইনের নিচ দিয়ে চলে গেছে একটি ছোট সড়কপথ—এরকমই একটি সুড়ঙ্গকে স্থানীয় লোকজন বলে সাঁকো। সেটি পার হয়ে পৌঁছালাম রূপপুর বাজারে।
রূপপুর বাজারে বেশ কিছু রুশ নাগরিককে দেখলাম। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজে তাঁরা এসেছেন এ দেশে। রূপপুর বাজারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বাংলা আর ইংরেজির পাশাপাশি রুশ ভাষায়ও লেখা। এমনকি সেখানকার সাধারণ মানুষ বেশ দক্ষতার সঙ্গে রুশ ভাষায় কথাও বলতে শিখেছেন।
এবার ফেরার পালা
রূপপুর বাজারে দুপুরের খাবার খেলাম। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ইজিবাইক চালককে ভাড়া চুকিয়ে বিদায় দিলাম। আমার ফিরতি ট্রেনের সময়ও হয়ে এল। কাছেই সেই পাকশী স্টেশন। এখান থেকেই আবার ফেরার ট্রেনে উঠব। দেরি না করে হাঁটতে শুরু করলাম স্টেশনের দিকে।
যেভাবে যাবেন পাকশীতে
ঢাকার বাস টার্মিনালগুলো থেকে পাবনার ঈশ্বরদী পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে সরাসরি বাস আছে। চাইলে বাসে যেতে পারবেন। বাসের বিকল্প হিসেবে আছে ট্রেন। খুলনাগামী আন্তনগর যেকোনো ট্রেনে এসে ঈশ্বরদী জংশনে নামতে পারেন। সেখান থেকে ইজিবাইকে পাকশী।