পাবনার ইউনিভার্সাল ফুড লিমিটেডের ২৪০ জন পরিবেশকের কাছ থেকে ৩৫ কোটি টাকা নিয়েও কোনো মালামাল সরবরাহ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ ১৯ মাসেও ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরত না দিয়ে পলাতক রয়েছেন ইউনিভার্সাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানী হোসেন।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) রাতে পাবনা প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স হলে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এমন অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশকরা। এর আগে বিকেলে পাবনা জেলা পরিষদ চত্বর- আব্দুল হামিদ রোডে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তারা অভিযোগ করেন, পাবনা শহরের দিলালপুরে অবস্থিত ইউনিভার্সাল ফুড লিমিটেডের টেস্টি স্যালাইনসহ বিভিন্ন পণ্য সারা দেশে পরিবেশকরা নিষ্ঠার সঙ্গে কমিশনের ভিত্তিতে পরিবেশন করে আসছেন। ২৪০ জন পরিবেশক ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে বিভিন্ন সময়ে পণ্যের জন্য কোম্পানির নিকট ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে পণ্য পাওয়ার শর্তে কোটি কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। টাকা পাওয়ার পর কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের পণ্য না দিয়ে কালক্ষেপণ করা হয়।
এমতাবস্থায় কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নানা অজুহাতে পণ্য না দিয়ে তালবাহানা শুরু করেন তারা। তখন কোম্পানির মালিক ড. সোহানী হোসেনের সঙ্গে পণ্য বাবদ পাওনা ৩৫ কোটি টাকা কবে এবং কিভাবে ফেরত দেওয়া হবে, এ ব্যাপারে কথা বললে তিনি বিভিন্ন তালবাহানায় সময়ক্ষেপণ করেন। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীদের চাপের মুখে গত বছরের নভেম্বর মাস হতে ৩ মাসের মধ্যে তাদের নিকট পণ্য সরবরাহ করে ব্যবসা চলমান রাখা হবে বলে সোহানী হোসেন স্বাক্ষরিত ইউনিভার্সাল গ্রুপের নিজস্ব প্যাডে লিখিত দেন। যার মেয়াদ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ হয়।
কিন্তু তাদের টাকা এবং পণ্য কোনটাই বুঝে পাননি ভুক্তভোগীরা। কোম্পানির মালিক এবং প্রতিনিধিরা পরিবেশকদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। সর্বশেষ গত কোরবানির ঈদের পর টেস্টি স্যালাইন চালু করে পাওনাদারদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেন তারা। গত ১০ জুলাই প্রতিষ্ঠান প্রধান সোহানী হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে এলে- ‘মেডাম ঢাকা গেছেন, আপনাদের সঙ্গে ২০ জুলাই দেখা করবেন’ বলে প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান। এদিকে, বৃহস্পতিবার ২০ জুলাই সকালে পাবনায় ভুক্তভোগীরা এসে সোহানী হোসেনের সঙ্গে সারাদিন ধরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর বিক্ষোভ- মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
লিখিত বক্তব্যে তারা আরও অভিযোগ করেন, বিভিন্ন জেলার এবং থানার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সরকারি নিয়ম অনুসারে সঠিকভাবে তারা ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। ইউনিভার্সালকে টাকা দিতে গিয়ে ব্যাংক এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছেন। পণ্য ও টাকা কোনোটাই না পেয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণের সুদ দিতে দিতে নিঃস্ব হয়েছেন তারা। এমনকি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের অনেকের বাড়িঘরও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। আবার অনেকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে মূলধনের অভাবে।
ঝিনাইদহ থেকে এসেছেন ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি ইউনিভার্সাল থেকে ৫৪ লাখ টাকা পাব। আমরা ১২ থেকে ১৫ বারের মতো পাবনায় এসেছি। কিন্তু সোহানী মেডামের দেখা পাইনি। আমাদের সঙ্গে তিনি বিভিন্ন তালবাহানা করেছেন। আমরা কেউ এখনো টাকা পাইনি। এখন বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয়। টাকা ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত আমরা বাড়িতে ফিরে যাব না। আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।
ইউনিভার্সাল ফুডের পরিবেশক কামাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, সোহানী হোসেন আমাদের মালামাল দেওয়ার কথা বলে ডিলারদের কাছ থেকে ৩৫ কোটি টাকা নিয়ে মালামাল সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি।
তিনি আরও বলেন, সোহানী হোসেন টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা না করে পলাতক রয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আমরা এখানে এসে অসহায়ের মতো হয়ে গেছি। আমাদের কর্মসূচি না করতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা এখানে আটকে থাকায় আমাদের ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে। আমাদের কোম্পানিতে যারা চাকরি করতেন, তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পাওনা টাকা ফেরত পেতে আমরা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ইউনিভার্সাল ফুডের পরিবেশক মো. কামাল হোসেন, মো. শফিকুল ইসলাম, বিমলেন্দু ভট্টাচার্য, একে সাইফুদ্দিন বাবলু, রানা হোসেন, নয়ন হোসেন, ফারহান ইসলাম, অশোক রায়, পলাশসহ দেশের প্রায় সব জেলা থেকে আসা ৮০ জন পরিবেশক।
এ বিষয়ে ইউনিভার্সাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানী হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ফোন করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে গ্রুপের পাবলিক রিলেশন অফিসার ফয়সাল মোর্শেদ টিটু বলেন, আমাদের কিছু কথা আছে। তাদের পাওনার বিষয়ে হিসাব-নিকাশ করতে হবে। সোহানী মেডামের সঙ্গে কথা বলে পাওনাদারদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
পাবনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী বলেন, ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে এসেছিলেন। আমাদের কাছে তারা অভিযোগ দিয়ে মামলা করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে বলেছি তাদের টাকা ফিরিয়ে দিতে। এ বিষয়ে পুলিশ সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।