প্রকৃতির বৈরী আচরণে চলতি বছর মৌসুমি ফল লিচুর ফলন কম হওয়ায় খানিকটা আক্ষেপ ছিল চাষিদের। কিন্তু বাজারে ওঠানোর পর ভালো দাম পাওয়ায় খুশি লিচু চাষি ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ঈশ্বরদীতে চলছে মৌসুমি ফল লিচু ভাঙা ও বাজারজাতকরণের উৎসব। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকারের ধারণা, এ বছর ঈশ্বরদীতে ৫০০ থেকে ৫৫০ কোটি টাকার লিচুর ব্যবসা হবে।
ঈশ্বরদী এখন পাকা লিচুর রঙে লাল। উপজেলার সলিমপুর, সাহাপুর, লক্ষীকুন্ডা ও দাশুড়িয়া ইউনিয়নে বাড়ি বাড়ি চলছে লিচুর উৎসব। গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে লাল বর্ণের রসালো ফল লিচু। এসব গাছ থেকে কেউ লিচুর আহরণ, কেউ বাছাই-বাচাই, কেউবা ব্যস্ত প্যাকেট করতে। শুধু বাগান নয়, হাটের অবস্থাও একই। চোখ যেদিকে যাবে সেই দিকেই রসালো ফল লিচুর ঝুড়ি। কারো মাথায় লিচুর ঝুড়ি, আবার কারো ভ্যান ভর্তি লিচু। বেচাকেনাতেও লিচুর জমজমাট অবস্থা। লিচুর এই সরগরম ঈশ্বরদীর লিচুর হাট ও বাগানগুলোতে।
দেশের সব জায়গাতেই ঈশ্বরদীর লিচুর কদর রয়েছে। লিচুর চাহিদা ও দাম বেড়ে যাওয়ায় এটির চাষ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিনাজপুরসহ দেশের কয়েকটি জেলায় লিচুর উৎপাদন হলেও ভৌগলিক কারণে ঈশ্বরদীর লিচুর বাজারজাত শুরু হয় একটু আগেই।
সরজমিনে দেখা যায়, বাগান থেকে লিচু পেড়ে তা ঝুড়িতে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঈশ্বরদীর বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ীরা ট্রাকে করে লিচু নিয়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ এলাকায়। সবকিছু মিলিয়ে সেখানে তৈরি হয়েছে উৎসবের আবহ। রাজধানীসহ নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ট্রাকবোঝাই করে লিচু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
এবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে লিচুর ফন কিছুটা কম। এবার লিচুর যখন মুকুল এসেছিল তখন অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে, ফলে মুকুল ঝরে গেছে। আবার যখন লিচু বৃদ্ধির সময় ছিল তখন বৃষ্টির অভাব ছিল, অতিরিক্ত তাপমাত্রা ছিল। ফলে লিচু আকারে ছোট হয়েছে এবং ফলন অনেক কম হয়েছে। গত বছর যে গাছে ৫-১০ হাজার লিচু হয়েছে সেই বাগানে এবার ৩-৭ হাজার লিচু হয়েছে।
তবে ফলন বিপর্যয় হলেও দামে খুশি চাষিরা। লিচুর বেচাকেনায় জমজমাট হয়ে উঠেছে লিচুর হাটগুলো।
প্রথম দিকে মোজাফফর (স্থানীয় নাম আটি) জাতের লিচু বিক্রি হয়েছে হাজারে ১ হাজার থেকে ১৫শ টাকায়, সেই দুই সপ্তাহ পর চলতি সপ্তাহের শুরুতে সেই মোজাফফর জাতের প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে ১৫শ থেকে ২২শ-২৫শ টাকা। এ সপ্তাহের শুরুতে লিচু আরেক জাত বোম্বাই কেনাবেচা শুরু হয়েছে। বোম্বাই প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে ২৫শ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকার ওপরে।
ঈশ্বরদীর সলিমপুরের লিচুচাষী সাহেব আলী বলেন, এ বছর তার ৮০টি লিচু গাছের মধ্যে ৪৫ থেকে ৫০টি গাছে ভালো ফলন হয়েছে। লিচুর মুকুল আসার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বৃদ্ধির সময় বৃষ্টির অভাবে ভালো কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায়নি বলেও মন্তব্য্য করেন তিনি।
জাতীয় প্রদকপ্রাপ্ত কৃষক শাহজাহান আলী পেঁপে বাদশা বলেন, এবার লিচুর ফলন কম, কিন্তু দাম খুব ভালো। আমরা খুশি। আমি প্রতিদিন ৪-৫ হাজার লিচু নিয়ে আসি এই হাটে। এই দাম অব্যাহত থাকলে কৃষকরা কিছু লাভবান হবে। তবে হাটের তুলনায় বাগানেই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে লিচু। কারণ- বাগান থেকে ব্যাপারীরা সরাসরি লিচু কিনে বাগান মালিকদের থেকে।
শিমুলতলা লিচু হাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও আড়তদার আদর্শ ফলভান্ডারের মালিক লিটন প্রামাণিক বলেন, গত কয়েক দিন থেকে দেশের বিখ্যাত ও সুস্বাদু বোম্বে লিচু হাটে ওঠা শুরু হয়েছে। চায়না লিচুও আসছে। দেশি লিচুর চেয়ে বোম্বে ও চায়না লিচুর দাম বেশি। খেতেও সুস্বাদু। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকার লিচু শুধু শিমুলতলা হাট থেকেই বিক্রি হচ্ছে।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকারের বলেন, স্বাভাবিকভাবেই যে গাছে ৯০-৯৫ শতাংশ লিচু ধরে পরের বছরে সেই গাছে ৬০-৬৫ ভাগ গাছে মুকুল আসে। এ জন্য এবার ফলন কম। তবে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। আমাদের কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের সার ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় দমন বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পরামর্শ দিয়েছিলাম। বৈরী আবহওয়ার কারণে গাছে স্প্রে করারও পরামর্শ দিয়েছিলাম এবং কৃষকরা সেটা করেছে। এ কারণে মোটামুটি ভালো ফলন এসেছে।