দ্বিতীয় দফায় ঈশ্বরদীতে আবারও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি রেকর্ড হয়েছে। ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক নাজমুল হক রঞ্জন জানান, বুধবারও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৮ ডিগ্রি রেকর্ড হয়েছে। ঈশ্বরদীর ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ।
এর আগে সোমবার (১৭ এপ্রিল) ঈশ্বরদীর তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি রেকর্ড হয়। তিনি জানান, ৩৬-৩৮ ডিগ্রি মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮-৪০ ডিগ্রি মাঝারি আর ৪০-৪২ ডিগ্রি তীব্র তাপপ্রবাহ। ৪২ ডিগ্রির ওপরে ওঠায় অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়েছে।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ডে পুড়ছে ঈম্বরদী জনপদ। গত কয়েকদিন ধরেই বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। প্রখর খাঁ খাঁ রোদ দিনের বেলায় আগুনের মতো হল্কা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ায় রাস্তাঘাট-হাটবাজার এমনকি ঈদ বাজারেও লোক সমাগম কম। ঈশ্বরদীতে বিরাজমান তীব্র ও অতি তীব্র তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। পাশাপাশি বাতাসে জলীয় বাস্পের পরিমাণ কম থাকায় ঘরের বাইরে বের হলেই রোদের প্রখরতায় যেন শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ঘরেও স্বস্তি নেই। লোডশেডিং জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত শীতপ্রধান এলাকার বিদেশি নাগরিকেরা। তীব্র তাপপ্রবাহ উপেক্ষা করেই তারা দিনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বিদেশিদের কর্মস্থল ও আবাসিক এলাকার বাইরে ঘোরাফেরা করতে এখন খুব কম দেখা যাচ্ছে।
সরেজমিনে রূপপুর প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিদের আবাসিক গ্রিনসিটি এলকায় এখন ভিন্ন চিত্র। যেখানে শত শত বিদেশি নাগরিকের পদচারণায় মুখর থাকে তা জনমানবশূন্য। গ্রিনসিটির আশেপাশের দোকানগুলোও বন্ধ। প্রকল্পের শ্রমিকরা জানান, গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। তীব্র তাপের মাঝেই কাজ করতে হচ্ছে। স্থানীয়রা নিজেরা তাপ সইতে কিছুটা অভ্যস্থ হলেও বিপদে পড়েছেন প্রকল্পে নিয়োজিত রুশসহ অন্যান্য বিদেশি নাগরিকেরা।
রমজানের সময় তীব্র তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন শ্রমজীবী মানুষ। দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রোজাদার ও রোগীরা। প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাচালক হাসিবুর বলেন, সড়কে মানুষের চলাচল তুলনামূলক কম। মালিকের জমা ছাড়াও সংসারের চাল-ডাল কেনার খরচ জোগাতে কষ্ট হলেও রিকশা চালাতে হচ্ছে। ঈশ্বরদী জংশন স্টেশনে তীব্র গরমে যাত্রীদের হাঁসফাঁস করতে দেখা গেছে। প্লাটফর্মে ফ্যান না থাকায় ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রীদের অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
ঈশ্বরদী শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে দিনে বেচাকেনা কমে গেছে। ইফতারির পর থেকে মাঝরাত পর্যন্ত বেচাকেনা হচ্ছে।
তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হলে ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। বিশেষ করে বোরো ধান ও লিচুচাষিরা চলমান আবহাওয়ায় বেশি শঙ্কিত। পদকপ্রাপ্ত লিচুচাষি আব্দুল জলিল কিতাব মণ্ডল জানান, চলতি বছর এমনিতেই লিচুগাছে ৫০ ভাগ গাছে ফুল এসেছে। এরই মধ্যে তীব্র দাবদাহের কারণে ৫০ ভাগ গুটি ঝরে গেছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে এবারে ঈশ্বরদীতে লিচুর ফলন বিপর্যয় ঘটবে।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, তীব্র খরা পরিস্থিতি বিরাজমান। চলতি বোরো ধানের জমিতে সবসময় ২-৩ ইঞ্চি পানি রাখতে হবে। পাশাপাশি বোরো ধানের জমিতে বিঘাপ্রতি পাঁচ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে।
লিচুর বিষয়ে তিনি বলেন, লিচু বাগানে সেচ দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই দিনে সেচ দেওয়া যাবে না। রাতে দিতে হবে। এখন সারের প্রয়োজন নেই। তাপমাত্রা কমলে সার প্রয়োগ করতে হবে।
এদিকে অতিমাত্রায় রোদ আর গরমে শুকিয়ে তলানিতে নেমেছে চারপাশের পুকুর ও খালের পানি। খরায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। উপজেলা জুড়ে দেখা দিয়েছে পানি সংকট। প্রায় ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার মানুষ বিশুদ্ধ পানি সংকটে ভুগছে।
ঈশ্বরদী জুড়েই তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছে। পৌর এলাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ফতেহ মোহাম্মদপুর, পূর্ব-নূরমহল্লা, আমবাগান, আলহাজ ক্যাম্প, মাহাতাব কলোনিতে দেখা যায়, শতকরা ৯৫ ভাগ বসতবাড়ির টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। যাদের বাসাবাড়িতে সাবমার্সেবল বা গভীর নলকূপ রয়েছে তারা সুপেয় পানি পাচ্ছেন। পানির জন্য বেশিরভাগ মানুষকে মসজিদের গভীর নলকূপে ভিড় করতে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া এলাকার যে টিউবওয়েলে সামান্য পানি উঠছে সেখানে বালতি, কলসি, জগ হাতে নিয়ে মানুষ ভিড় করছেন।
বস্তিপাড়ার শাহনাজ বেগম জানান, একদিকে প্রখর রোদ ও গরম অন্যদিকে পানির জন্য হাহাকার। দিন যেন আর চলছে না। রোজা থেকে পানির জন্য অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। এখানে কোন নলকুপ বা পানির সাপ্লাই লাইনের ট্যাপ থাকলে এ সংকট পোহাতে হত না।
উপজেলা সহকারী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মাহাবুব ইসলাম জানান, পানির স্তর ৩০ ফুটের নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। বৃষ্টিপাত হলে পানির স্তর স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বৃষ্টিপাত না হওয়া পর্যন্ত সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।
পৌর মেয়র ইছাহক আলী মালিথা জানান, টিউবওয়েলে পানি উঠছে না বা পানি সংকটের বিষয়টি শুনেছি। পানি সংকট নিরসনের জন্য আমাদের গাড়ি বা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। যারা সাপ্লাই পানি ব্যবহার করছে তাদের এ সংকট নেই।