ঈশ্বরদীর ব্যস্ততম সড়ক রেলগেট। এটি ঈশ্বরদী শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। দিনে দিনে রেলগেট সড়ক দিয়ে ভারী ও সব ধরনের যানবাহন এবং পথচারীদের চলাচল বাড়লেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭ ঘণ্টাই রেলগেট বন্ধ থাকায় লেভেল ক্রসিংয়ে যানজটের কবলে পড়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় শহরবাসীকে। সম্প্রতি ট্রেনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রেলগেটের এই ভোগান্তি আরো প্রকট হয়েছে।
ঈশ্বরদীবাসীর অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই রেলগেট। এটি ঈশ্বরদীর পূর্ব ও পশ্চিম টেংরীকে পৃথক করে রেখেছে। রেলগেটের কারণে অবহেলিত পশ্চিম টেংরীবাসী। নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এই এলাকার বাসিন্দারা। রেলগেটের কথা চিন্তা করে রিকশাচালক যেতে চায় না বলেও জানালেন স্থানীয় অধিবাসীরা। রেলগেট চত্বরে ফ্লাইওভার নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের হলেও এখন পর্যন্ত পূরণ হয়নি বহুল প্রত্যাশিত এই দাবি।
ঈশ্বরদী রেলস্টেশন সূত্রে জানা যায়, এই রেলগেট দিয়ে দিনের ২৪ ঘণ্টায় ২৮টি ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে রয়েছে আন্তঃনগর (আপ-ডাউন) ১৮টি, মেইল ট্রেন (আপ-ডাউন) ৪টি, মৈত্রী এক্সপ্রেস ২টি ও মালবাহী ট্রেন ৪টি।
রেলগেট প্রতিদিন ৭ ঘণ্টা বন্ধ থাকায় স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী-পরীক্ষার্থী, রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ইপিজেডে কর্মরতদের যানবাহন, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের চলাচলসহ জীবনযাত্রা থমকে পড়ে। প্রতিদিনই এখানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে দায়িত্বরত ট্রাফিকদের হতে হয় নাকাল।
রেলগেটের উত্তরে জংশন স্টেশন। কাছেই কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। পূর্ব-পশ্চিম সড়কের সংযোগস্থল ছাড়াও রেলগেটের ওপর দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঈশ্বরদী ইপিজেড, পাকশী রেলওয়ে বিভাগীয় অফিস, উপজেলা সড়ক ও রাজশাহী পর্যন্ত সড়কপথে যোগাযোগ রয়েছে।
যুগ যুগ ধরে ঈশ্বরদীবাসী যানজটের ভোগান্তি পোহালেও সমস্যার নিরসন হচ্ছে না। প্রতিটি ট্রেন চলাচলের সময় ১০-২০ মিনিট হিসাবে যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য ২৪ বার ছাড়াও মালবাহী ও তেলবাহী ট্রেন চলাচলে বন্ধ থাকে রেলগেট। বৃহত্তম জংশনের রেল ইয়ার্ডে সান্টিং কাজেও কোনো কোনো সময় রেলগেট বন্ধ রাখতে হয়। এ সময় উভয় পাড়ে সৃষ্টি হয় যানজট। এতে হাজার হাজার মানুষের ভোগান্তির পাশাপাশি সময় নষ্ট হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলগেটের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে উপজেলা পরিষদসহ ১৭টি দপ্তর, ইপিজেড, ভূমি, সাব-রেজিস্ট্রি, বিমানবন্দর বিভাগীয় রেলওয়ে পে এন্ড ক্যাশ অফিস, দুটি স্কুল এন্ড কলেজ, ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অপরদিকে রেলগেটের পূর্বপ্রান্তে রয়েছে ফায়ার সার্ভিস, বাজার, থানা, সদর হাসপাতাল, ক্লিনিক, দুটি কলেজ, বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র, বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট, জাতীয় ডাল গবেষণা কেন্দ্র, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ পরমাণু গবেষণা উপকেন্দ্রসহ সরকারি-বেসরকারি স্কুল ও কলেজ। সব প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র এই রেলগেট।
ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমাঞ্চল রেলের বৃহত্তম ঈশ্বরদী জংশন স্টেশন আগের নিয়মেই পরিচালিত হচ্ছে। সময় অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে এবং বর্তমান সরকারের রেলপথের উন্নয়নের কারণে ট্রেনের সংখ্যা এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
এদিকে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাশেই নির্মাণ হয়েছে নতুন রেললাইন। দেশের বহু রেলগেটে এরই মধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতির লক সিস্টেম চালু হলেও ঈশ্বরদী রেলগেটে মান্ধাতা আমলের লক সিস্টেমই রয়ে গেছে। যাত্রীবাহী, তেলবাহী কিংবা মালবাহী ট্রেন ঈশ্বরদীর আগে বা পরের স্টেশন থেকে ছাড়ার সময় রেলগেটটি সুইস কেবিনের মাধ্যমে বন্ধ হয়। ট্রেন রেলগেট পার না হওয়া পর্যন্ত খোলা হয় না।
রিকশাচালক শুকুর আলী বলেন, প্রতিদিনই যাত্রী নিয়ে আধা ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চাহিদামতো দিনে ভাড়া খাটতে পারি না। স্থানীয় ব্যবসায়ী সাগর সাহা বলেন, রেলগেটে যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী। ঘণ্টায় ঘণ্টায় যানজটে রাস্তা পারাপার কঠিন হয়ে পড়ে।
ঈশ্বরদী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের ওয়্যার হাউস ইনচার্জ অপু কুমার মন্ডল বলেন, অগ্নিনির্বাপক বা জরুরি সেবামূলক কাজে পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্তে যাওয়ার সময় প্রায়ই রেলগেটে যানজটের কবলে পড়তে হয়। উপজেলা প্রকৌশলী এনামূল কবীর জানান, ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য এক বছরেরও বেশি সময় আগে ঢাকার টিম জরিপ করেছে।
ঈশ্বরদী রেলগেট ফ্লাইওভার নির্মাণে বাংলাদেশ রেলওয়ের আপত্তি নেই। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে এখানে ফ্লাইওভার না থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগের বিষয়টি তুলে ধরেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ্বাস। এখানে ফ্লাইওভার নির্মাণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
ঈশ্বরদী পৌর মেয়র মো. ইছাহক আলী মালিথা বলেন, ঈশ্বরদীর প্রধান সমস্যা হিসেবে এই রেলগেট চিহ্নিত। সমস্যা সমাধানে ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য জাতীয় সংসদে স্থানীয় এমপি প্রস্তাবসহ বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করছেন বলে জানি। এ বিষয়ে পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, ঈশ্বরদী রেলগেটে ফ্লাইওভার নির্মাণের জন্য জাতীয় সংসদে প্রস্তাব উপস্থাপন করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, জনদুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে এখানে খুব দ্রুত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে।