রিকশাচালক মোতালিব মৃধা। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর রামপুরা বাজার এলাকায় রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে রুটি-কলা খাচ্ছিলেন। দুপুরে ভাত না খেয়ে রুটি কলা কেন খাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাতের চেয়ে কলা-রুটিতে খরচ একটু কম পড়ে। তাই দুই দিন ধইরা দুপুরে ভাতের বদলে রুটি-কলা-শিঙাড়া খাইতেছি।’
নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে নিম্ন আর মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষ কম খেয়ে কাজ বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। মোতালেব যেমন চলছেন, গ্রামের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী, তিন সন্তান এবং বৃদ্ধা মা আছেন। প্রতি সপ্তাহে তাদের তিন হাজারের মতো টাকা পাঠাতে হয়। ঢাকায় তাঁর থাকা-খাওয়ার খরচও মাসে কয়েক হাজার টাকা। আগে দিনে ৯ ঘণ্টা রিকশা চালাতেন। কিন্তু হিসাব মেলাতে মাস দুয়েক ধরে রিকশা চালানোর সময় তিন ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
মধ্যবিত্তদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই উপায়টুকুও থাকছে না। তাদের বাইরেরটাও বজায় রাখতে হয়, ভেতরটাও সামলাতে হয়। বেসরকারি চাকরিজীবীরা জানান, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে দিনে কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা হলেও প্রতিদিনই ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা অফিসের কাজে ব্যয় হয়। এরপর আর অন্য কাজের উপায় থাকে না। আর বছরে যে পরিমাণ বেতন বাড়ে, বাজারদর বেড়ে যায় তার চেয়ে বেশি।
গতকাল রাজধানীর রামপুরা, সিপাহীবাগ, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি আটাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬০ টাকায়। আর মিনিকেটের কেজি ৭৫ টাকা। বেশির ভাগ দোকানেই প্যাকেটজাত চিনি নেই। খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকা কেজিতে। সয়াবিন তেল পাঁচ লিটারের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকায়। আর খোলা তেল কেজিপ্রতি ১৯৫ টাকা। আমদানিকৃত বড় দানার মসুর ডাল ১০০ টাকা কেজি ও ছোলার ডাল ১০০ টাকা।
গতকাল বিকেলে রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় কথা হয় গৃহকর্মী মমতাজ বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, সকালে পান্তাভাত আর মরিচভর্তা খেয়ে কাজে বের হতেন। কিন্তু মাসখানেক ধরে সকালে আর পান্তা থাকছে না। কারণ, চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় রান্নার পরিমাণ কমিয়েছেন। সকালে পান্তার বদলে দুটো পান মুখে পুরে বাসা থেকে বের হন। দুপুর পর্যন্ত ওই পানের ওপরেই চলে। গত নভেম্বর পর্যন্ত দিনে তিন বাসায় কাজ করতেন মমতাজ। খরচ বাড়তে থাকায় ডিসেম্বর থেকে পাঁচ বাসায় কাজ শুরু করেছেন তিনি। আর চলতি মাস থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও দুই বাসা।
মমতাজ বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খাওন কমাচ্চি, কাইজ বাড়াচ্চি। তারপরও চইলতে পারতিচ না।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে গতকাল ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ২০০ থেকে ২৩০ টাকা। ফার্মের লাল ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৩৮-৪০ টাকায়। দেশি পেঁয়াজ ৩০ টাকা আর আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজের দাম ৩৫-৪০ টাকা। বাঁধাকপি প্রতিটা আকারভেদে ২০-৩০ টাকা, আলুর কেজি জাতভেদে ২৫-৩০ টাকা। এ ছাড়া কেজিপ্রতি টমেটো ৪০-৫০ টাকা, মুলা ৪০, পেঁপে ৪০, শসা ৬০, গাজর ৪০, তাল বেগুন ১০০ টাকা করে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আবির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার গড়ে প্রায় সাড়ে ৮ শতাংশ। গত দুই বছরে আমার বেতন ২ হাজার টাকা বেড়ে এখন ২০ হাজার টাকা। মুদ্রাস্ফীতি হিসাবে নিলে এই ২০ হাজার টাকা এখন ১৮ হাজার ৩০০ টাকার সমান। তার মানে দুই বছরে আমার উপার্জন বেড়েছে কার্যত ৩০০ টাকা। অথচ এক মাসে শুধু গ্যাস সিলিন্ডারের দামই বেড়েছে আড়াই শ টাকা। আর বিদ্যুতের দাম দুই মাসে বেড়েছে তিনবার। মুরগি, ডিম, মাছ, সবজি—সবকিছুই নাগালের বাইরে। কীভাবে চলব বলেন?’