দীর্ঘ ১৮ বছরেও ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লীর সফল বাস্তবায়ন হয়নি। বেনারসি তাঁতিদের জন্য তাঁত বোর্ড ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই বেনারসি পল্লীর প্রকল্প হাতে নেয়। পাঁচ একর জমির ওপর রয়েছে ৯০টি প্লট। মাত্র ৭টি প্লটে কারখানা স্থাপিত হয়েছে। পল্লীর বিশাল এলাকা ঝোপঝাড়-জঙ্গলে ভরা। হয়েছে সাপ-পোকার আড্ডা। ফাঁকা জায়গায় বিকেলে চলে স্কুলগামী শিশুদের খেলাধুলা। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলে মাদকসেবী আর বখাটেদের আড্ডা। একসময় ছিল ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য।
সাতচল্লিশে দেশভাগের পর উত্তর ভারতের কয়েকটি অঞ্চল থেকে কয়েকজন অবাঙালি বেনারসি কারিগর ঈশ্বরদীর ফতেহমোহাম্মদপুর এলাকায় বসতি গড়ে তোলেন। বেনারসি ও কাতানসহ বেশ কয়েক ধরনের অভিজাত শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পুরোনো সেই কারিগরদের আর কেউ জীবিত নেই।
বংশ পরম্পরায় তাদের উত্তরসূরিদের কেউ কেউ পৈতৃক ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। এখনো প্রায় দুই শতাধিক বেনারসি ও কাতান শাড়ির কারিগর এই পেশা ধরে রেখে জীবিকা নির্বাহ করেন। আবার কেউ কেউ ভারত থেকে শাড়ি এনে বেনারসি পল্লির শাড়ি বলে চালিয়ে দিচ্ছেন।
তাঁতিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য থাকার সময় ঈশ্বরদীর বেনারসি শিল্পকে রক্ষায় এ প্রকল্প অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। এরই প্রেক্ষিতে সরকার তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে ২০০৪ সালে ফতেহমোহাম্মদপুরে একটি বেনারসি পল্লী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। সে অনুযায়ী ২০ বছর মেয়াদে এ পল্লী গড়ে তোলা হয়। ৫ একর জমির ওপর ৯০টি প্লট করে স্বল্পমূল্যে তা তাঁতিদের বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৭ সালে বরাদ্দ নেওয়া জমিতে মাত্র সাতটি কারখানা তৈরি করা হয়।
মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) সরেজমিনে দেখা যায়, ফতেহমোহাম্মদপুর এলাকার তাঁতপল্লীর পাশেই এই বেনারসি পল্লী। পল্লীর প্রধান গেট খোলা। ছোট গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে ফাঁকা প্লট, আগাছা আর গহীন জঙ্গলে ভরা দৃশ্য। রয়েছে মাত্র কয়েকটি কারখানা এবং পল্লীর সরকারি অফিস। মাঝখানে মসজিদ। শুধু মসজিদের এলাকা ছাড়া বাকি এলাকা ঝোপঝাড়ে পূর্ণ।
চালু থাকা কারখানার মধ্যে ২টি জামান টেক্সটাইলের। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থেকে তারা এসেছেন। পল্লীতে তাদের নিজস্ব কোনো প্লট বরাদ্দ নেই। স্থানীয় এক তাঁতির নামে বরাদ্দ করা ২টি প্লট ভাড়া নিয়ে কারখানা তৈরি করেছেন।
তাঁতিরা জানান, প্লট বরাদ্দের সময় কথা ছিল বেনারসি শাড়ি তৈরির জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। উৎপাদিত শাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছরেও এসব সুবিধা পাওয়া যায়নি। এখানে সুতা প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, সেটিও হয়নি।
তারা জানান, ঢাকা থেকে সুতা প্রক্রিয়া করে আনতে হয়। এতে ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা প্রতি শাড়িতে খরচ বেড়ে যায়। পল্লীতে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। একজন ম্যানেজার পল্লী দেখশোনা করেন। ফলে স্থানীয় তাঁতিরা বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে প্লটগুলো খালি পড়ে আছে। চালু কারখানার মালিকরা স্থানীয় নয়, বাইরের জেলা থেকে এসেছেন।
জামান টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপক শরিফুল আলম জানান, ফতেহমোহাম্মদপুরে বেনারসি তৈরির দক্ষ কারিগর রয়েছেন। ভালো কারিগরের আশায় তারা কারখানা করেছেন। দুটি কারখানায় ৩০টি তাঁত আছে। সপ্তাহে ২৫-২৭টি শাড়ি তৈরি হয়। তবে বেনারসি পল্লীর সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। এখানে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ করেন।
তাঁতি জাবেদ বেনারসি জানান, তাঁতিদের সুবিধার্থে বেনারসি পল্লী স্থাপিত হলেও কোনো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নেই। যে কারণে স্থানীয় তাঁতিরা সরকারি পল্লীতে যাননি। বাড়িতেই কষ্ট করে কাজ করছেন। ঈশ্বরদীর বেনারসির সুনাম ও চাহিদা থাকায় ফতেহমোহাম্মদপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে কয়েকটি শাড়ির দোকান। এসব দোকানে ভারত থেকে কাতান-বেনারসি এনে ঈশ্বরদীর শাড়ি বলে বিক্রি হচ্ছে।
বেনারসি পল্লীতে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তা ওবায়দুর রহমান বলেন, মূলত তাঁতি সমিতির মাধ্যমে পল্লীর প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এতে প্রকৃত তাঁতিরা প্লট বরাদ্দ পাননি। অনেকবার স্থানীয় তাঁতিদের নিয়ে বৈঠক করলেও পল্লীতে কারখানা করতে তারা আগ্রহী নন।
তিনি আরও বলেন, অনেকেই প্লটের কিস্তির টাকা এখনও পরিশোধ করেননি। নিয়ম ভেঙে অনেকে আবার প্লট বিক্রি করে দিয়েছেন। সম্প্রতি তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
সুযোগ-সুবিধা প্রসংগে তিনি বলেন, তাঁতিরা তো এখানে কারখানাই করেননি। কারখানা করলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।