পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার সেই কৃষকদের বিরুদ্ধে ঋণসংক্রান্ত মামলা ও ঋণের কিস্তি নিয়ে জটিলতার বিষয়টি তদন্ত করতে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের তিন সদস্যের একটি দল পাবনায় পৌঁছেছে। আজ রোববার বিকেলে পাবনায় এসে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে দলটি। এ সময় জেলা প্রশাসক কৃষকদের ঋণের সুদ মওকুফের জন্য তদন্ত দলকে সুপারিশ করেন।
তিন সদস্যের এই তদন্ত দলের প্রধান হলেন বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (পরিদর্শন ও আইন) মো. আহসানুল গণি। অপর দুজন হলেন সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প ও ঋণ) আবদুর রাজ্জাক ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক (আইন) আমিনুল ইসলাম। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ব্যাংকটির পাবনা শাখার ব্যবস্থাপক কাজী জসিম উদ্দীন।
তদন্ত দলের সদস্যরা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বলেন, তাঁরা ঋণগ্রহীতা সদস্যদের ঋণ দান, ঋণ আদায় ও পরিশোধের সব তথ্য পর্যালোচনা করতে পাবনায় এসেছেন। আগামীকাল সকাল ১০টায় ভাড়ইমারি উত্তরপাড়া সবজিচাষি সমবায় সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন তাঁরা। ঋণ পরিশোধের কাগজপত্রও দেখবেন। এর তিন দিন পর ঢাকায় ফিরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।
তদন্ত দলের প্রধান মো. আহসানুল গণি জেলা প্রশাসককে বলেন, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক সমাজসেবা অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশনকৃত একটি ব্যাংক। ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ও কো-অপারেটিভ ব্যাংক নীতিমালায় চলে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর নিয়ম মেনে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ কৃষকদের ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।
জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা ও যাবতীয় বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে অবগত আছেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিষয়টি তদারক করার জন্য বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কৃষকদের ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। কৃষকদের সুদ মওকুফ করে কীভাবে বিষয়টি সমাধান করা যায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ভাড়ইমারি উত্তরপাড়া সবজিচাষি সমবায় সমিতির সভাপতি বিলকিস নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক বিষয়টি তদন্ত করবে, এটা বেশ ভালো উদ্যোগ। তবে কৃষকেরা আগেই বলেছেন, তাঁদের কাছে ঋণ পরিশোধের কোনো কাগজ নেই। গ্রামের কৃষকেরা এসব কাগজের প্রয়োজনীয়তা বোঝেন না। তাঁরা অনেকেই ঋণের টাকা জমা দেওয়ার পর রসিদ সংরক্ষণ করেননি। ঋণ পরিশোধের সব তথ্য ব্যাংকের কাছেই সংরক্ষিত আছে।
মামলায় জামিনে থাকা প্রায় ১৫ কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের অধিকাংশ ভাঙাচোরা টিনের ঘরে বাস করেন। তাঁদের ঘরে কাগজ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। কেউ চালের হাঁড়িতে, কেউ কৌটায়, কেউবা টিনের চালার নিচে কাগজ রেখেছিলেন। দীর্ঘদিন হয়ে যাওয়ায় সেগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে, এখন আর তা খুঁজে পাচ্ছেন না।
মহির উদ্দিন প্রামাণিক নামের এক কৃষক বলেন, ২০১৬ সালে তাঁরা ঋণ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে কত কিছু ঘটে গেছে। অনেকে নতুন বাড়ি বানিয়েছেন। কেউ নতুন ঘর তুলেছেন। ঋণ পরিশোধের ওই কাগজের কথা তাঁদের মাথাতেই ছিল না।
কৃষক রাজ্জাক প্রামাণিক বলেন, ‘আমরা তো জানতেম না মামলা হবি। ইয়ের জন্যি জেল খাটা লাগবি। ইতা জানলি তো সব বাদ দিয়ে আগে ওই কাগজ বাঁচাতেম।’
ঈশ্বরদী উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের ভাড়ইমারি গ্রামে ‘ভাড়ইমারি উত্তরপাড়া সবজিচাষি সমবায় সমিতি’ নামের কৃষকদের একটি সমিতি আছে। এই কৃষকেরা বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে ১৬ লাখ টাকা ঋণ নেন। কৃষকদের দাবি, তাঁরা এ ঋণের ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সমবায় ব্যাংক আরও ১৩ লাখ টাকা পাওনা দাবি করে এবং ঋণের শর্তভঙ্গের দায়ে প্রতারণার মামলা করে। মামলায় আদালত ৩৭ কৃষকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ১২ কৃষককে গ্রেপ্তার করে গত ২৫ নভেম্বর আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়। রোববার গ্রেপ্তার ১২ জনসহ ৩৭ কৃষক জামিনে মুক্তি পান।