এশিয়ার বৃহত্তম রেলসেতু ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সেতু বন্ধন ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’। ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ সেতু উদ্বোধনকালে সেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেলস আবেগভরে জনতার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, যে সেতু নির্মাণ করে গেলাম উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এ সেতু চির যৌবনা হয়ে থাকবে। কথাটি যে কতখানি সত্য তার প্রমাণ গত ২০১৫ সালের ৪ঠা মার্চ শতবর্ষ পূর্ণ করার পরও সেতুর গায়ে বয়সের কোন ছাপ পড়েনি।
১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের মঞ্জুরি পাওয়ার পর ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যর রবার্ট উইলিয়াম গেইলস ও স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিং-এর ওপর হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব অর্পণ করেন। প্রধান প্রকৌশলী রবার্ট শুধু ব্রিজের নকশা প্রণয়ন করেন। ব্রিজে রয়েছে ১৫টি মূল স্প্যান। একেকটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২’শ ৫০ টন। রেললাইনসহ মোট ওজন ১ হাজার ৩’শ টন। ১৫টি স্প্যান ছাড়াও দু’পাশে রয়েছে ৩টি করে অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান। ব্রিজের মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮’শ ৯৪ ফুট, এক মাইলের কিছুটা বেশি। ব্রিজ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল রেইথ ওয়ালটি অ্যান্ড ক্রিক। এসময় প্রমত্তা পদ্মার ছিল রূপ ছিল ভয়াল।
ব্রিজ নির্মাণের শত বছর পরেও পৃথিবীর প্রকৌশলীদের নিকট আজও বিস্ময়, ব্রিজ নির্মাণের কাজ বা রিভার ট্রেনিং ওয়ার্ক । ১৯১২ সালে ব্রিজের গাইড ব্যাংক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ৪ থেকে ৫ মাইল উজান থেকে ব্রিজের গাইড ব্যাংক বেঁধে আনা হয়। লোহা ও সিমেন্টের কংক্রিটের সাহায্যে নির্মিত হয় বিশাল আকৃতির পায়া গুলো। সেই সময়ের হিসেব অনুযায়ী মূল স্প্যানের জন্য ব্যয় হয় ১ কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার ৭৯৬ টাকা। স্থাপনের জন্য ৫ লাখ ১০ হাজার ৮৪৯ টাকা, নদী শাসনের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ টাকা এবং দু’পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১৭৩ টাকা। অর্থাৎ একশ বছর আগেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে মোট ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৯ হাজার ১৬৪ টাকা। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বিশেষ বিশেষত্ব হলো ভিত্তির গভীরতা। ব্রিজ নির্মাণে ২৪ হাজার ৪’শ শ্রমিক কর্মচারী ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে। ১৯১৫ সালে ব্রিজের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই বছরের ১লা জানুয়ারি ব্রিজের এক (ডাউন) লাইন দিয়ে মালগাড়ি যাতায়াত শুরু করে। এর ২ মাস পর ৪ঠা মার্চ তৎকালীন ভাইরস লর্ড হার্ডিঞ্জ ডবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করেন। তারই নামানুসারে ব্রিজের নাম হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকবাহিনী খুলনা ও যশোরে পরাজয়ের পর পিছু হটে ঈশ্বরদীতে সমাবেত হওয়ার উদ্দেশ্যে একটি ট্রেনে আসছিল। এসময় ১৩ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যে মিত্রবাহিনী বিমান হতে বোমা নিক্ষেপ করলে ১২ নম্বর স্প্যানটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর যথারীতি ভারত সরকার ব্রিজটিকে মেরামত করে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনে।
পাকশী বিভাগীয় রেলের সেতু প্রকৌশলী আব্দুর রহিম ইত্তেফাককে জানান, নির্মাণের সময় এর আয়ুষ্কাল একশ বছর ধরা হয়েছিল। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সময়কালে ১০৭ বছরেও চিরযৌবনা এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। ২০১৫ সালে শতবর্ষ পূর্ণ হলেও পরিকল্পনা মাফিক এর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিজাইন পিরিয়ডের চেয়েও লৌহ কাঠামোর রাসায়নিক ধাতুর গুণাবলী আরও কমপক্ষে আরও ২৫ বছর বলবৎ থাকবে বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে। উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের সেতুবন্ধনকারী ঐতিহাসিক এই সেতুটির কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ফলে ব্রিজ ২০৪০ সাল পর্যন্ত কার্যকরী থাকছে। ইতোমধ্যেই সরকার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উজানে নতুন করে বিকল্প আরেকটি ব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে বলে বিভাগীয় সেতু প্রকৌশলী জানিয়েছেন।
শত বছর আগে অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার সঙ্গে কলকাতা এবং অন্যান্য স্থানের যোগাযোগের মূল লক্ষ্যই ছিল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সময়ের গতিধারায় ব্রিটিশ শাসনের পর ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ‘যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি’র ক্ষেত্রে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আজও তার উজ্জ্বল ভূমিকায় মহিমান্বিত। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কারণেই আগামীতে আরও আঞ্চলিক সহযোগিতার দ্বার এমনকি এশিয়ান হাইওয়ে উন্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।