দ্বিতীয় ইউনিটে পরমাণু চুল্লি পাত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ প্রায় চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছেছে। দেশীয় প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোগত নির্মাণসহ পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনায় প্রতিনিয়ত সক্ষমতার প্রমাণ রেখে চলেছেন। নির্মাণ দক্ষতায় সাধারণ শ্রমিকরাও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। যে কারণে গত ১৯ অক্টোবর দ্বিতীয় ইউনিটে পরমাণু চুল্লি পাত্র স্থাপন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান একই সুরে বলেছেন ‘আমরাও পারি’। প্রকল্পের রাশিয়ার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রসাটম বাঙ্গালিদের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। বাঙ্গালি এসব দক্ষ মানবসম্পদ বিদেশে বড় বড় প্রকল্পে কাজের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ মানবসম্পদ বিদেশে কাজের ক্ষেত্রে যেন প্রতারণার শিকার না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ নজরদারির প্রয়োজন বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মতামত ব্যক্ত করেছেন।
রূপপুর প্রকল্পের ভৌত অবকাঠামোগত নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই প্রকল্পে ২০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী কাজ করছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান জানান, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে এসব কর্মীর অভিজ্ঞতার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পুরো জাতিকে আলোকিত করার মতো রূপপুর প্রকল্প জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সম্মেলনে যোগ দিতে আমরা ভিয়েনা গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবরের সাথে হাঙ্গেরির প্রতিনিধিদল যোগাযোগ করেছে। তারা আমাদের দেশের শ্রমিকদের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। হাঙ্গেরি তাদের পঞ্চম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে বলে জানান তিনি। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে হাঙ্গেরি শ্রমিক সংকটে পড়েছে। তারা আমাদের দেশের অভিজ্ঞ শ্রমিকদের কাজে নিতে চায়। রূপপুর প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আমরা বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উদ্যোগ গ্রহণ করবো।
রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ ১৯ অক্টোবর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে রূপপুর এনপিপি সাইটে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। এসময় তিনি বলেন, নতুন ও আধুনিক এই কেন্দ্রটি পরিচালনার সাথে যেসকল বাংলাদেশী যুক্ত থাকবেন তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। বিশেষায়িত শ্রেণীকক্ষ ছাড়াও স্টেট-অফ-দা-আর্ট ইকুইপমেন্ট সজ্জিত বিশেষ স্থাপনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন বিশেষজ্ঞরা। রুশ পক্ষ এই প্রশিক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগত প্রোগ্রাম প্রণয়ন করেছেন, যা ব্যবহার করে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ পক্ষ নিজেরাই তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হবেন।
প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার নির্দেশনা মেনে, বিদেশ নির্ভরতা নয়, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় দেশীয় প্রকৌশলীদের ওপরই আস্থা রাখতে চায় বাংলাদেশ। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখানে রাশিয়ান ও বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা প্রশিক্ষণ দেবেন। পাশাপাশি আমরা দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলছি, যাদের কর্মদতা ইতিমধ্যেই রাশিয়ান নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি কেড়েছে। হাঙ্গেরি আমাদের অভিজ্ঞ শ্রমিকদের কাজে নিতে অত্যন্ত আগ্রহী। রাশিয়ান নীতিনির্ধারকরাও আমাদের কর্মীদের ওপর সন্তুষ্ট। এই বাস্তবতায় মিসর, তুরস্ক, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের দক্ষ জনশক্তির কাজের ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী রাশিয়ার এতমস্ট্রয় এক্সপোর্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যালেক্সি ডেইরি বলেন, রূপপুর প্রকল্পে যেসব বাংলাদেশিরা কাজ করছেন, তাদের আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। আত্মবিশ্বাসের সাথে আমি বলতে পারি, আমরা শুধু শ্রমিক বা কর্মী তৈরি করিনি, বরং সত্যিকার অর্থে পেশাদার মানবসম্পদ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। যারা শুধু যান্ত্রিক কাজই নয়; বরং তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম। গুণগত মান সম্পূর্ণভাবে বজায় রেখে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রকল্পের উপ-পরিচালক হাসিনুর রহমান বলেন, পারমাণবিক দক্ষ জনশক্তি বাংলাদেশের অদম্য অগ্রযাত্রার মুকুটে নতুন পালক যুক্ত করবে এতে সন্দেহ নেই। এই দক্ষ মানবসম্পদের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ডাটাবেইজ তৈরি করা প্রয়োজন। এসব মানবসম্পদ বিদেশে কাজ করে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে আনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে। বিদেশে এই মানবসম্পদ যেন প্রতারণার শিকার না হয় এবং ন্যায্য প্রাপ্তিতা নিশ্চিতের জন্য সংশ্লিষ্টদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।