শুক্রবার , ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. আইন ও আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. ঈশ্বরদী
  5. করোনাভাইরাস
  6. কৃষি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খেলাধুলা
  9. গল্প ও কবিতা
  10. চাকরির খবর
  11. জাতীয়
  12. তথ্যপ্রযুক্তি
  13. তারুণ্য
  14. ধর্ম
  15. নির্বাচন

উৎসব হোক সবার

প্রতিবেদক
বার্তা কক্ষ
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২ ৫:৩৪ অপরাহ্ণ
উৎসব হোক সবার

শরতের সুনীল আকাশে শ্বেতশুভ্র মেঘের আনাগোনা। আরেক সাদা কাশবন কেবলই ঝলমলে উন্মুখ-উদ্বেল হতে শুরু করেছে নদ-নদীর রুপালি চরবচর। প্রকৃতি এভাবেই জানান দিয়েছে শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। মর্ত্যলোকের মালাকার পল্লীতে এখনই দুর্গতিনাশিনী রূপে ধরা দিয়েছে দেবী। আবারও দুর্গাপূজা ফিরছে উৎসবের রঙে। কেননা গত দুই বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়েছে দুর্গাপূজা। এ বছর সেই সব বিধিনিষেধ নেই। গত বছরের চেয়ে এবার ৫০টি বেশি মন্দিরে পূজা উদ্যাপন হবে। গত বছর ৩২ হাজার ১১৮টি মন্দিরে পূজা উদ্যাপন হয়। এবার এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ১৬৮টি।

রোববার মহালয়ার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। আগামী পয়লা অক্টোবর ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। আর ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে তা শেষ হবে।

পূজা আসলেই কেমন যেন অনুভূতি তৈরি হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে শঙ্কা তৈরি হয়। এই বছর পূজাটি কেমন হবে? ভালভাবে সম্পন্ন করতে পারবো তো ইত্যাদি ইত্যাদি। এই শঙ্কাটা স্বাভাবিকই বলা যায় কারণ প্রতিবছরই তো কোন না কোন মন্দিরে প্রতিমা ভাংচূরের ঘটনা ঘটছে। একটি বছর পর সবচেয়ে বড় উৎসব যেখানে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হওয়ার কথা সেখানে শঙ্কা তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কাম্য হতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ একটি বিচিত্র দেশ যেখানে নানান জাতির বসবাস। সেখানে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের ব্যর্থতাই প্রকাশ পায়।
অন্যদিকে এই উৎসব আসলেই একটি গোষ্ঠী নিজেদের ধর্ম কায়েম করার সময়, স্বার্থহাসিলের সময় বা একটি অস্থিতিশীলতা তৈরির সময় মনে করে প্রতিমা ভাংচূর করতে লিপ্ত হয়। আর এই কাজটি করতে গিয়ে তারা শুধু শঙ্কায় তৈরি করে না, রাষ্ট্রের আইন, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও অসাম্প্রদায়িতক চেতনা ক্ষুন্ন করে।

দুর্গা নামের বুৎপত্তিগত অর্থ যিনি দুর্গ অর্থাৎ সঙ্কট হতে ত্রাণ করেন। শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ শব্দটির একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ‘দুর্গা’র ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ ( ু ) বিঘœনাশক, ‘রেফ’ (র্ ) রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও ‘আ-কার’ ( া ) ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘœ, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।

পন্ডিতরা বলছেন, শরৎকালের প্রথম শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে মহালয়ার দিনে দেবীঘট স্থাপন করে শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। শরতকালের এ পক্ষকে দেবীপক্ষও বলা হয়ে থাকে। শাস্ত্রে আছে, দেবীদুর্গা হিমালয়বাসিনী দক্ষরাজার কন্যা। পিতৃগৃহে আগমন উপলক্ষে ষষ্ঠীর দিনে বিজয় শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে মর্ত্যলোকে মা দুর্গার আগমনকে স্বাগত জানানো হয়। এটিই দেবীর বোধন। এরপর যথাক্রমে মহাসপ্তমীতে নবপত্রিকা প্রবেশ, অষ্টমীতে কুমারী ও সন্ধিপূজা এভাবে নবমী পার হয়ে দশমীর দিনে দেবী বিসর্জন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলেও পক্ষকাল চলে বিজয়া পুনর্মিলনী উপলক্ষে বিভিন্ন লোকজ উৎসব।

দেবী দুর্গার সৃষ্টি-রহস্যসমৃদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ শ্রীশ্রীচন্ডীতে উল্লেখ আছে, ব্রহ্মা মহিষাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়েছিলেন কোন পুরুষ তোমাকে বধ করতে পারবে না। ব্রহ্মার বর পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে মহিষাসুর। একে একে বিতাড়ন করেন স্বর্গের সব দেবতার। উপায়ন্তর না পেয়ে দেবতারা অবশেষে ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হন। কিন্তু কী করবেন তিনি। নিজের দেয়া বর ফেরাবেন কী করে? এ অবস্থায় শিব ও অন্যান্য দেবতা সঙ্গে নিয়ে ব্রহ্মা যান স্বয়ং বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু তাদের দুর্দশার কথা শুনে দেবতাদের বলেন, দেবতাদের নিজ নিজ তেজকে জাগ্রত করতে হবে। তখন দেবতাদের সমবেত তেজের মিলনে আবির্ভূত হবে এক নারী মূর্তি। সেই নারীই বিনাশ করবে মহিষাসুরকে। বিষ্ণুর থেকে সবকিছু অবগত হয়ে দেবতারা হিমালয়ের পাদদেশে পুণ্যসলিলা গঙ্গার সামনে এসে প্রার্থনা শুরু করেন। দেবতাদের সম্মিলিত তেজরাশি থেকে দশদিক আলোকিত করে আবির্ভূত হন এক নারীমূর্তি। ইনিই দেবী দুর্গা নামে অভিহিত। তিনি আবির্ভূত হন দশভুজারূপে। দেবতাদের সব দুর্গতি বিনাশ করায় দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, মহিষমর্দিনী এবং অসুরদলনী নামেও পরিচিত। বৈদিক সূত্রে এ দেবীর উল্লেখ আছে। পুরাকালে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল বসন্তকালে। এ সময় দেবী দুর্গা ‘বাসন্তী’ নামে পূজিত হতেন যা এখনও প্রচলন আছে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, সেদিন ‘কন্যারূপে’ বাপের বাড়ি অর্থাৎ মর্ত্যে আসেন দেবী দুর্গা। অসুর শক্তি বিনাশকারী দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্য দিয়ে সমাজ থেকে দূর হবে সকল পাপ। সমাজে ফিরে আসবে শান্তি। এবছর দেবী দুর্গা আসছেন গজে। এতে রবি শস্য ভাল হবে। দেবী বিদায়ও নেবেন নৌকায় চরে। এতে দূর হবে সকল অসুখ বিসুখ। দেবীর যাত্রার সময় সকল অসুখ বিসুখ ধূলোর সঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাবেন।

মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার পরিবারসমন্বিতা মূর্তির প্রচলন হয় ষোড়শ শতাব্দির প্রথম পাদে। পরিবারসমন্বিতা এই মূর্তিকাঠামোর মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী। তাঁর উপরিভাগে ধ্যানমগ্ন মহাদেব। মহিষাসুরমর্দিনীর ঠিক ডানপাশে উপরে দেবী ল²ী ও নীচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নীচে কার্তিক। পরিবারসমন্বিতা এই রূপে দুর্গাপূজা প্রথম অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহিরপুরে। কংসনারায়ণের পূজার পরপরই আড়ম্বরপূর্ণ দুর্গাপূজার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন অবিভক্ত বাংলার জমিদাররা। নতুন আঙ্গিকের এই পূজার শাস্ত্রীয় ও সামাজিক আয়োজন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় দুর্গাপূজা পরিনত হয় জমিদারদের উৎসবে। জমিদারী প্রথা বিলোপের পর দুর্গোৎসবে জমিদারদের অংশগ্রহণের হার কমে আসে স্বাভাবিকভাবেই। নব্য ধণিকশ্রেণীর উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্গোৎসব আয়োজকগোষ্ঠীতে যুক্ত হয় অনেক নতুন মুখ। তবে প্রতিটি দুর্গোৎসবই তখন আয়োজিত হত সম্পূর্ণ একক উদ্যোগে। আনুমানিক ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে একটি ঘটনা ঘটে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায়। গুপ্তিপাড়ার একটি ধনী পরিবারের আকস্মিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে অনিশ্চয়তার সন্মূখীন হয় বাড়িটির বাৎসরিক পূজার আয়োজন। গুপ্তিপাড়ার বারো জন বন্ধুস্থানীয় যুবক তখন এগিয়ে আসে সামনে। এই বারো জন ‘ইয়ার’ বা বন্ধু সংঘবদ্ধ ভাবে গ্রহণ করে পূজাটির দায়িত্ব্। গুপ্তিপাড়ার এই পূজাটি মানুষের কাছে পরিচিত হয় ‘বারোইয়ারি’ বা বারোয়ারি পূজা নামে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বাংলায় দুর্গাপূজার সংখ্যা বাড়ল ব্যাপকহারে। তারপর থেকেই বিভিন্ন বাড়োয়ারী মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় উৎসবটি।

দূর্গার বিবরণের মধ্যে কোথাও কি অন্য ধর্মকে নিয়ে, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে, অমানবিক কোন কথার প্রচলন আছে? সনাতনধর্মাবলম্বীরা যে দেশে সংখ্যায় কম সে দেশে তাদের উৎসব নিয়ে শঙ্কা যেমন হচ্ছে ঠিক অনুরূপভাবে যে দেশে সনাতনধর্মাবলম্বীরা বেশি সে দেশে সংখ্যা কম জাতির উৎসব নিয়ে শঙ্কা হয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা সকলেই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং আমাদের নির্ভরশীলতার জায়গা আস্থার হওয়া দরকার। সমাজে সকল মানুষই অসাম্প্রদায়িক তা নয় আবার সকলেই সাম্প্রদায়িক তা কিন্তু নয়। যে মূর্তি পূজার বিরোধিতা করে, সে মূর্তি ভাঙলে তাঁর পূণ্যি বা হালাল হয় বলে আমার মনে হয় না। সুতরাং এখনও যারা সেই ইসলামের ভাষায়, আইয়ামে জাহেলিয়ার যুগে বিরাজ করছে সে ইসলাম ধর্ম পালন করছে বলে আমার কাছে মনে হয় না।

জগতের সকল কিছুই সৃষ্টি শুভর জন্য। তবুও অশুভর আগমন ঘটে, ঘটেছে, ঘটবে। জীবনে যেমন সুখ-দু:খ রয়েছে তেমনি জগতেও থাকবে শুভ ও অশুভ। তবে অশুভর বিদায়ে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। কারণ অশুভ কখনও কাক্ষিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারে না। সবসময় অশুভর পরাজয় ঘটে। যেভাবে মহিষাসুর নামক অসুরদের হাত থেকে দেবকুলকে রক্ষা করেছিল মহামায়া দূর্গা। শুভর আগমন কেউ কখনও রুখতে পারবে না। যেমনটা পারে নি সকল ধর্মে, সকল দেশে যুগে যুগে, সময়ে সময়ে। ধর্ম থাক ধারণের জায়গায়। পৃথিবীতে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলের আগমন ও প্রস্থান এক। ব্যবধান শুধু নামাজ-পূজায়। একই আকাশে একই বাতাসে লালিত-পালিত হয়ে আমার চিন্তা আলাদা হতে পারে না। আমার ধর্ম আলাদা হতে পারে। তাইতো যুগে যুগে সকল নবী-মণীষী মানবতার কথাই বলেছেন। জীবসেবার কথায় বলেছেন। হানাহানি ও সংঘাতের পথ ছেড়ে শান্তির বাণী প্রচার করেছেন। শান্তির ঐক্যমতে পৌছাতে পারলে প্রতিটি দিনই আমার জন্য হবে সুদৃঢ়। শারদীয় উৎসব হোক শঙ্কামুক্ত ও উৎসবমূখর। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার হোক এটাই আমার কাম্য।

লেখকঃ গোপাল অধিকারী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]
০১৭২৩-০৯১২১৩

সর্বশেষ - ঈশ্বরদী

error: Content is protected !!