‘আমরা বেহেশতে আছি’—পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের এমন মন্তব্যের সমালোচনা এখনো থামেনি। এর আগেই আরেক বিতর্কের সূত্রপাত করলেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্টমীর এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতে গিয়ে আমি বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাঁকে টিকিয়ে রাখলে আমাদের দেশ সত্যিকার অর্থে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত একটি দেশ হবে। তাই আমি ভারতকে শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার সেটি করতে বলেছি।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে দেশজুড়ে নতুন করে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। তাঁর এই মন্তব্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন। সরকার ও দলের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন অনেকে। তবে আব্দুল মোমেন তাঁর বক্তব্যের পেছনে নানা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, ‘আমি নিশ্চয়ই বলব।’
গত ১২ আগস্ট সিলেটের এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। আমরা সুখে আছি, বেহেশতে আছি।’ এর আগে ২০১৯ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘উভয় দেশের সম্পর্ক খুবই ভালো। অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো। টুকটাক মতানৈক্য থাকলেও মিটে যায়।’ এ নিয়েও সে সময় বিতর্ক কম হয়নি।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে নানা কথা বলে দলকে বিব্রত করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি আগেও বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো। এই ভাষা তিনি কোথায় পেলেন? পরে আমেরিকায় গিয়ে নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে দেশটির সহযোগিতা চেয়েছিলেন। আর এখন বললেন, শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছেন। আমরা যেখানে বলছি, বিএনপি ক্ষমতায় আসার জন্য বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। সেখানে এর বিপরীত বক্তব্য দিয়ে আমাদের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘এটা নিয়ে আমরা হতাশ ও বিব্রত।’
বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের বেশির ভাগই প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্যের কাছে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তাঁরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেননি বলে দাবি করেন। এ বিষয়ে তাঁরা কোনো মন্তব্যও করেননি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্যে প্রচণ্ড বিরক্ত সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মাস্টাররোলে চাকরি করেন তো, তিনি বেতনভুক্ত কর্মচারী, তাঁকে মন্ত্রী বলা যাবে না। কোথায় কী কথা বলতে হবে, এই সেন্স যাদের হয়নি, তাদের বিষয়ে কী বলব? দেখেন, আমাদের দলের জ্যেষ্ঠ কোনো নেতা কিছু বলেন কি না। আমরা দর্শকই থাকি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘অনেকের মতো আমিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে কষ্ট পেয়েছি। আমাদের সবার উচিত সংযত হওয়া। নেত্রী প্রতিদিন যে বক্তব্য দিচ্ছেন, সেগুলো উপলব্ধি করা এবং সেই মর্মার্থ বুঝে কথা বলা।’
তবে গতকাল শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘শেখ হাসিনার সরকারকে টিকেয়ে রাখার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করার’ কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘সেটা আমি বলি নাই। আমি বলেছি, এই দেশের স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। স্থিতিশীলতা আছে বলেই আমরা উন্নয়ন করতে পারছি। আমি বলেছি, শেখ হাসিনা সরকারে থাকায় দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নের ফলে ভারতবর্ষও লাভবান হচ্ছে। শেখ হাসিনা আছেন বলেই, স্থিতিশীল সরকার থাকায় ভারতবর্ষেরও উন্নয়ন হচ্ছে। তারাও সুবিধায় আছে। তাদের বিভিন্ন খরচপাতি ইদানীং করতে হয় না। সেই জন্য আমি বলেছি, আমরা আমাদের সরকারকে স্থিতিশীল রাখতে চাই এবং রাখব। আপনারা (ভারত) বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে আমাদের প্রচেষ্টায় সাহায্য করলে খুশি হব। আমরা সারা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা চাই।’
ভিডিওতে দেখা গেছে, আপনি বলেছেন, ভারতে গিয়ে আমি বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে—এমন বক্তব্যে আবদুল মোমেন বলেন, ‘অবশ্যই উনি আমাদের আদর্শ, তাঁকে আমরা টিকাই রাখব। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের বন্ধুপ্রতিম সবাইকে অনুরোধ করব। আপনারা আমাদের সাহায্য করবেন। আপনাদের কোনো অসুবিধা আছে এটাতে? শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখলে কোনো অসুবিধা আছে? অন্য দেশকে এভাবে অনুরোধ করা যায় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আমার সব বন্ধুপ্রতিম দেশকে বলব, আমাদের সাহায্য করা উচিত। আমার দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় আমাদের সাহায্য করুন। আমি নিশ্চয়ই বলব। আমি শত্রুকে গিয়ে বলব না, বলব বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোকে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বললেও সমালোচনার ঝড় থামছে না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের সমালোচনা করছেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আকারে-ইঙ্গিতে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরাতে বলছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের সাবেক এক সহসভাপতি বলেন, উনি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছেন। ওনারে সরানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার ভারতকে অনুরোধ করে না। গতকাল রাজধানীর পলাশীর মোড়ে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সমর্থন ও ক্ষমতার উৎস দেশের জনগণ। বাইরের কেউ আমাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। আর এটা তাঁর (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। আমাদের সরকারের কারও বক্তব্য নয়।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমি দেখি নাই উনি কী বলেছেন। বিষয়টি আমি বুঝে নিই, তারপর বলছি।’