বৃহস্পতিবার , ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অর্থনীতি
  2. আইন ও আদালত
  3. আন্তর্জাতিক
  4. ঈশ্বরদী
  5. করোনাভাইরাস
  6. কৃষি
  7. ক্যাম্পাস
  8. খেলাধুলা
  9. গল্প ও কবিতা
  10. চাকরির খবর
  11. জাতীয়
  12. তথ্যপ্রযুক্তি
  13. তারুণ্য
  14. ধর্ম
  15. নির্বাচন

জন্মের চেয়ে নিবন্ধন কঠিন!

প্রতিবেদক
বার্তা কক্ষ
ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২২ ৬:৪৪ অপরাহ্ণ
জন্মের চেয়ে নিবন্ধন কঠিন!

পূর্ব নাখালপাড়ার বাসিন্দা দেবাশীস রায় তার শিশুসন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাবেন। ভর্তি করতে গেলেই স্কুল থেকে বলা হয়, সন্তানের জন্ম নিবন্ধন সনদ লাগবে। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর আঞ্চলিক কার্যালয়ে (মহাখালী) যান সন্তানের জন্ম নিবন্ধনের জন্য। সেখান থেকে বলা হয়, সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করাতে হলে বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন লাগবে। কিন্তু দেবাশীস দম্পতি আগে কখনো জন্ম নিবন্ধন করাননি। বিদ্যমান আইনে জন্ম নিবন্ধন করতে হলে জন্মের প্রমাণপত্র হিসেবে হাসপাতালের ছাড়পত্র বা শৈশবে টিকা গ্রহণের প্রমাণপত্র থাকতে হবে। দেবাশীস দম্পতি সেটাও হারিয়ে ফেলেছেন। পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখালেও তা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এখন তিনি বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্তাব্যক্তির কাছে ধরনা দিচ্ছেন কীভাবে সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করা যায়।

কেবল এই একটি ঘটনাই নয়, সারাদেশের অসংখ্য মানুষ এখন নিজের বা সন্তানের জন্ম নিবন্ধন নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। তারা বলছেন, ভোগান্তি ও কায়দা-কানুন এমন যেন জন্মের চেয়ে নিবন্ধন কঠিন হয়ে পড়েছে।

কিন্তু কেন এই ভোগান্তি? সে প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, এই জন্ম নিবন্ধন নিয়ে এত সমস্যা দেখা দিচ্ছে যে বাধ্য হয়ে এটা আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের এত অভিযোগ আমরা আর শুনতে চাচ্ছি না। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তিনিই এখন এটার দেখভাল করছেন। ডিএসসিসির ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফখরুদ্দিন মোবারক বলেন, বর্তমান নিয়মে সবার অনলাইন নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ এক সময় দেখা গিয়েছিল দেশে লোকের সংখ্যা ১৬ কোটি কিন্তু ১৮ কোটি মানুষের রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে। কিন্তু তাদের মনে হয় দেশের ৩০ শতাংশের মতো জনগণ রেজিস্ট্রেশন করেছেন। একেকজন বিভিন্ন জায়গা থেকে তিন-চারটি সনদ নিয়েছেন। এ জন্য নিয়মে কড়াকড়ি করা হয়েছে। আবার নতুন নিয়মে এতই কড়াকড়ি হয়েছে যে সংশোধন করতে হলে ভুক্তভোগীকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দৌড়াতে হবে। আবার এই কাজটা তাদের হাতেও নেই। রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের একটি সার্ভার আছে। সেই সার্ভার থেকে সিটি করপোরেশন এ সেবা দেয়। অথচ এখন সব দায় সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকারগুলোকে নিতে হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইমদাদুল হক বলেন, আপনাদের সাংবাদিকদের কাছে হয়তো দুয়েকজন অভিযোগ জানায়। আর জন্ম নিবন্ধন নিয়ে প্রতিদিন আমাদের কাছে এত অভিযোগ আসছে তা বলাও যায় না। এ নিয়ে তিনি রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার জেনারেল ওসমান ভুইয়া বলেন, এই কড়াকড়ি তো খালি খালি হয়নি। একটি শিশুর বিপরীতে বিভিন্ন জন্মতারিখ দিয়ে ৩৭টি জন্ম সনদ নেওয়ার কাহিনীও তাদের হাতে ধরা পড়েছে। যে কারণে নতুন নিয়ম করা হয়েছে। তবে এই কড়াকড়ির কারণে যে ভোগান্তি হচ্ছে তা যাতে না হয়, সে জন্য তারা খুব শিগগিরই উদ্যোগ নেবেন। প্রয়োজনে আইন সংশোধনেরও চিন্তাভাবনা চলছে।

ওসমান ভুইয়া আরো বলেন, সবাই যদি সন্তানের জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধনটা করে ফেলেন তাহলে আর সমস্যা হবে না।

ভোগান্তির নেপথ্যে: কেন এই ভোগান্তি সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৪ সালে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন করা হয়। এ আইনের আওতায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী-লিঙ্গ নির্বিশেষে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে সবাইকে জন্ম নিবন্ধনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া মৃত্যুরও ৪৫ দিনের মধ্যে ওয়ারিশদের মৃত্যু সনদ সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়। এরপরই ১৮টি কাজের জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রথম দিকে বিষয়টি ঢিলেঢালা ও সহজভাবে এ কার্যক্রম চলত। যে কেউ চাইলেই যেকোনো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হাতে লেখা জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে কোনো কড়াকড়িও ছিল না। কিন্তু ২০১৭ সালে গিয়ে দেখা গেল, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বিপরীতে জন্ম নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কারণ হিসেবে স্কুলে ভর্তির সময় জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করার কারণে অভিভাবকরা ইচ্ছেমতো একই সন্তানের বিপরীতে একাধিক জন্ম সনদ নিয়েছেন। ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সসীমার বিধিনিষেধের কারণে অভিভাবকরা এ কাজ অহরহই করেছেন। এমনকি অসংখ্যা শিশুর নামে একাধিক জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহের তথ্যও রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের নজরে আসে। অথচ রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় মনে করে, প্রকৃত পক্ষে দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ জন্ম নিবন্ধনের আওতায় এসেছে। বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর সরকার গত আগস্ট মাসে আইন সংশোধন করে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন-২০২১ প্রণয়ন করে। ওই আইনে জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।

নতুন নিয়মে যা করা হয়েছে: ২০০১ সালের ১ জানুয়ারির পর যাদের জন্ম তাদের জন্ম নিবন্ধন করতে হলে শিশুর জন্মের প্রমাণপত্র বা টিকার কার্ড লাগবে। সঙ্গে বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন যদি ইংরেজিতে হয়, শিশুর জন্ম নিবন্ধন হবে ইংরেজিতে। বাংলায় হলে শিশুর জন্ম নিবন্ধন হবে বাংলায়। তবে বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন পৃথক ভাষায় হলে সেটা সংশোধন করে দুজনের একই ভাষায় জন্ম নিবন্ধন সনদ আগে সংগ্রহ করতে হবে। এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়কে।

এর সঙ্গে প্রয়োজন হবে বাসার হোল্ডিং নম্বর ও চৌকিদারী-হোল্ডিং ট্যাক্স জমা দেওয়ার হালনাগাদ রশিদ। বাবা-মা বা তাদের পূর্বসূরীর নামে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের বিলের কপি। এছাড়া লাগবে আবেদনকারী বা অভিভাবকের মোবাইল নম্বর ও সন্তানের এক কপি পাসপোর্ট সাইজের রঙিন ছবি।

৪৬ দিন থেকে ৫ বছর বয়সীদের জন্ম নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের প্রত্যয়নপত্রসহ যাবতীয় তথ্যাদি। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র (পিএসসি/জেএসসি/এসএসসি) শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র না থাকলে সরকারি হাসপাতালের এমবিবিএস ডাক্তারের স্বাক্ষর ও সিলসহ প্রত্যয়ন সনদ।

২০০১ সালের আগে বাবা-মায়ের মৃত্যু হলে তাদের মৃত্যু সনদের প্রয়োজন হবে। ২০০১ সালের পর বাবা-মায়ের মৃত্যু হলে বাবা-মায়ের জন্ম সনদ আগে সংগ্রহ করতে হবে। পরে তাদের মৃত্যু নিবন্ধন সনদও গ্রহণ করতে হবে। উভয় সনদপত্র সন্তানের জন্ম নিবন্ধনের আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের প্রত্যয়নপত্র সংযুক্ত করতে হবে।

নতুন নিয়মের গ্যাড়াকলে ভোগান্তি চরমে: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিরপুলের এক দম্পতি জানান, প্রতিবন্ধী হওয়ায় সন্তানের ব্যাপারে তারা উদাসীন ছিলেন। ইতোমধ্যে সন্তান যুবকে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি তারা জানতে পারেন প্রতিবন্ধীদের জন্য নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে সরকার। এমনকি মাসে মাসে ভাতাও দেয়। বিষয়টি জানার পর সম্প্রতি সন্তানের জন্ম নিবন্ধনের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয়ে যান। সেখান থেকে বলা হয়, জন্ম সনদে প্রতিবন্ধীর বিষয় উল্লেখ রাখতে হলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র লাগবে। তিনি স্থানীয় কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে যাওয়ার পর বলা হয়, কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে আরেকটি অনুমতি আনতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের কথা তাকে বলে দেওয়া হয়। এতসব কাগজপত্র ও নিয়ম-কানুনের কারণে তিনি সন্তানের জন্মসনদ গ্রহণের সিদ্ধান্তই স্থগিত করে দিয়েছেন।

মিরপুরের মণিপুরের বাসিন্দা ও ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র অনিক বিশ্বাস জানান, দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর কলেজ থেকে বলা হয়, তার জন্ম সনদের বানানে ভুল আছে। কারণ কলেজে দেওয়া জন্ম সনদের প্রিন্ট কপিতে যা আছে আর জন্ম নিবন্ধনের ওয়েবসাইটে একটি বর্ণে হেরফের আছে। দুটি একই রকম না হলে তার ছাত্রত্ব থাকবে না। তার বাবা ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে যান সেটা সংশোধনের জন্য। আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে বলা হয়, জন্ম সনদের প্রিন্ট কপির বানানই যে সঠিক তার প্রমাণপত্র আনতে হবে। তখন এসএসসির সকল কিছু জমা দিলে বলা হয়, এটা হবে না। হাসপাতালের জন্ম সনদ দিতে হবে। অনিক বিশ্বাসের বাবা বলেন, হাসপাতালে জন্মের সময় ছাড়পত্রে যে নাম দিয়েছিলেন, সেটা পরবর্তীতে ব্যবহার করেননি। সন্তানের নতুন নাম রেখে জন্ম সনদ সংগ্রহ করে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। এখন সিটি করপোরেশনের লোকরা বলছে তাদের কিছু করার নেই। ডিসি অফিসে যোগাযোগ করতে তাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জন্ম নিবন্ধন নিয়ে এ রকম অসংখ্য মানুষের নানা ভোগান্তির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, সরকার দেশের সকল মানুষের একটি তথ্য সংরক্ষণের চেষ্টা করছে। এ জন্যই অনলাইন জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এতে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাতে আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন হলে সেটাও করা হবে। আমাদের লক্ষ্য জন্ম নিবন্ধন নিয়ে মানুষের যেন দুর্ভোগ না থাকে।

সর্বশেষ - ঈশ্বরদী

error: Content is protected !!